আবাসিক এলাকায় শপিংমল

সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে সাধারণ রাস্তা বা গলির আশেপাশে আবাসিক ভবন ভেঙে গড়ে উঠছে শপিংমল বা সুপার মার্কেট। রাস্তা বা গলির যেখানে-সেখানে ইট-পাথর-সুরকি-লোহাসহ বিবিধ নির্মাণ উপকরণ স্তূপীকৃত হয়ে থাকছে।

এ ছাড়া ভোর থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ডজন ডজন ট্রাক্টর-লরি-ভ্যান-এক্সকাভেটর এবং পাইলিং মেশিনসহ নির্মাণকার্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমিয়ে যানজট, কালো ধোঁয়া এবং শব্দদূষণ তৈরি করে চলেছে। শহর ও শহরতলিতে গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবনে হয়তো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকছে, কিন্তু উপেক্ষিত হচ্ছে আবাসিক এলাকার জনস্বাস্থ্য-শান্তি-স্বস্তি। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার দরকার। বহুতল ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা দোকান যত হবে মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বিবিধ অপরাধ প্রবণতা: যেমন চুরি-ছিনতাই, মাদকাসক্তি ও পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই।

যদি তুলনামূলক লাভক্ষতির হিসাবে এবং সাশ্রয়ী সংস্কৃতির নিরিখে মূল্যায়ন করা যায়, দেখা যায় যে, আজকাল দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু গ্রাহক ক্রমহ্রাসমান। ক্রেতা অধিকার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে, বাড়ছে প্রতারণার বিবিধ কৌশল। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা নেই। দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মচারীদের বেতন দিন দিন বকেয়া পড়ছে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা শুধু নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বিবিধ কর্মকাণ্ড অপেক্ষা অধিক মুনাফা যোগ করে থাকে, কিন্তু সেখানেও গুরুত্ব দিতে হয় কৌশলগত পরিকল্পনাকে। যেখানে-সেখানে বহুতল ভবন বা শপিংমল কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনায় হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসরণ হচ্ছে না বিল্ডিং কোড, ফায়ার সিকিউরিটি ও আবাসিক বাসিন্দাদের পরিবেশ ও জানমালের নিরাপত্তার বিষয়।

আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তি যখন তার বাসাবাড়ি কোনো ডেভেলপারকে দিয়ে শপিংমল এবং আবাসস্থল বা ফ্ল্যাট নির্মাণ করে, তখন পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বাসিন্দার জীবন-অস্তিত্ব হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। 

সমাজের বিত্তশালী ও সুবিধাভোগী শ্রেণি কোন যুক্তিতে অনেক দিনের আবাসিক এলাকা ভেঙে অন্যদের সার্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজ করছে তা বোধগম্য নয়। তবে আমরা জানি, সরকার আবাসিক এলাকা ধ্বংস করে শপিংমল বা সুপার মার্কেট নির্মাণের অনুমতি দেয় না। তারপরও দেশের আনাচে-কানাচে প্রশাসন ম্যানেজ করে বিল্ডিং নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া-নেওয়ার কাজ চলছে এতে সন্দেহ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেদিকে সূক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছেন বলেও মনে হয় না। প্রাচীন এক শ্লোকে বলা হয়েছে, 

বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্নী:

তদর্ধং কৃষিকার্য:

তদর্ধং রাজকার্য:

ভিক্ষায় নৈবচ নৈবচ।

আবহমান এই বাংলার মানুষজন কৃষিতেই অধিক মগ্ন থেকেছে। বাণিজ্যের তেমন প্রসার ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে মূলধন প্রয়োজন। অন্যদিকে রাজকার্য নিয়ে আগেকার ধ্যানধারণার পটভূমি এবং স্বরূপও পালটেছে। বোধকরি রাজকার্যেই বর্তমানে অধিক লাভ। সে যাক... শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পরিকল্পনাহীন এই যে ডজন ডজন শপিংমল ও সুপারমার্কেট, এতে সত্যিকার ব্যবসার কতটুকু প্রসার ঘটছে, এবং সেটি আদৌ ব্যবসার মুনাফামুখী চলমানতা বা গতিময়তা বৃদ্ধিসহ সাশ্রয়ী অর্থনীতি নিশ্চিত করে কি না এই প্রশ্ন উত্থাপন আজ স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

দেশের বিভিন্ন শহরে বিগত কয়েক বছর ধরে এই অপকর্মতৎপরতা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। অভিযোগ পাওয়া যায় যে, এসব ডেভেলপার ও ভূমি স্বত্বাধিকারী প্রশাসন ম্যানেজ করেই এসব করে চলেছে। আর তাই অভিযোগ আছে যে, একের পর এক আবাসিক এলাকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করে দেদার শপিংমলের মতো কোলাহলপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়ে চলেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশাসন।

বিপদে পড়ছেন সেইসব মানুষ যাদের বাস্তুভিটা নতুন শপিংমলের আশপাশে। বিল্ডিং নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারী যানবাহনের যান্ত্রিক শব্দ, শ্রমিক ও বিবিধ কোলাহল-শব্দদূষণ দিনরাত চলছে। শপিংমল চালু হওয়ার পর যে গলিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করত, বিকেলের আলোয় যে-সকল নারীপুরুষ খোলা হাওয়ায় হেঁটে বেড়াত, সে-সব বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি বাসাবাড়ি এবং পারিবারিক প্রাইভেসির জন্য ঘরের জানালাও খুলতে পারেন না।

এমন শপিংমল দেখা গেছে যে, গলির দক্ষিণ পাশে আবাসিক ভবন, মানুষের রাতের ঘুম দরকার, ওদিকে উত্তরপাশে মালামাল ওঠানামার চেঁচামেচি হট্টগোল ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিপজ্জনক কেমিক্যাল ও দাহ্যপদার্থের রিসিভ-ডিপারচার। এ ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস মালামালের জন্য যে গোডাউন তৈরি করেছে সেখানে যে-কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকে যায়।

আমরা ঢাকার নিমতলী ও অন্যান্য জায়গায় নিকট অতীতে এমন দুর্যোগ ও প্রাণহানির ঘটনা দেখেছি। মফস্বল শহরগুলোতে আবাসিক এলাকায় ব্যক্তিবিশেষের বাসস্থান ভেঙে শপিংমল বা সুপার মার্কেট নির্মাণ নির্দিষ্ট ওই এলাকার সকল অধিবাসীকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হচ্ছে শিশু-নারী-বয়সীসহ সকল মানুষ এবং তাদের সম্পদ। 

পৌর এলাকায় সত্তর ফুট উচ্চতার ঊর্ধ্বে কোনো ভবন নির্মাণের অনুমতি পৌরসভা দিতে পারে না। এটা প্রায় ছয়তলা বা ফাইভ স্টোরিড বিল্ডিং। এর ঊর্ধ্বে সপ্তম বা দশম তলা পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে প্ল্যান পর্যালোচনাসাপেক্ষে অনুমতি গ্রহণ আবশ্যক। একটি ভবন নির্মাণের জন্য বিল্ডিং আর্কিটেকচারাল নকশা বা পরিকল্পনা পৌরসভা বা অন্যান্য দপ্তরে অনুমোদনের জন্য জমা দিতে হয়।

সেই প্ল্যানের অনুলিপি পুলিশ প্রশাসন, ফায়ার ব্রিগেড, পরিবেশ এবং অন্যান্য দপ্তরের সরেজমিন অনুসন্ধান ও প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা শেষে অনুমতি প্রদানের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়। বিভিন্ন দপ্তর নির্ধারিত দিন ও সময়ের মধ্যে প্ল্যান বাস্তবায়নের অনুমোদন দিয়ে থাকে। শহরে এসব স্থাপনার নির্মাণ কার্যের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্ল্যান অনুমোদিত হওয়ার আগেই নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে।

এই নির্মাণ কার্যে যে সকল বিবিধ সমস্যার উদ্ভব, ততোধিক অনাসৃষ্টি এবং সমস্যা তৈরি হচ্ছে আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী মানুষজনের নিরিবিলি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে বিঘ্ন, ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা বিনষ্ট, পরিবেশ লঙ্ঘন এবং জানমালের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি ও বিনষ্টের মধ্য দিয়ে। নিরীহ অধিবাসীরা অর্থশালী ডেভেলপারের কাছে অসহায় আর নগণ্য হয়ে পড়ছে।

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //