হিরো আলম এত ঝামেলা করে কেন

“যেই দিন থেকে হিরো আলম নামের লোকটা আমাদের মিডিয়ার সামনে আসলো, তারপর থেকে শান্তির মা বিছানা নিলো। একদিকে মা কাতরায় আর অন্যদিকে এই লোক গান ছাড়ে, নাচ দিচ্ছে আবার অভিনয় করতে শুরু করছে। তারপর, নির্বাচন করছে। শান্তির মা আরও জোরে কাতরায়, কয় গেলাম, কিন্তু এই লোক তো আছেই। হিরো আলম রে কেউ থামা। না হয় ওরে গান শেখার মাস্টার দে, আর একটা ফেসিয়াল সার্জারির টাকা দে। আমাদের অনেক বিবি সাহেবরা ব্যাংকক সিঙ্গাপুর যায় এটা করতে, নতুন কিছু না। এরে সুশীল বানা, আমাদের মতো বানা। আর পারি না।” 

দুই

এক মন্ত্রীর কথা মনে আছে? মাথায় চুল নাই অথবা মাথা চাঁছা ঠিক জানি না। টেলিফোনে হুমকি দিয়েছিলেন এক অভিনেত্রীকে। পরে তার চাকরি যায়। তারপর কানাডা যান সেখানে ঢুকতে দেয়নি। পরে ফেরত এসেছেন। সেই মন্ত্রীর এক ভিডিও আছে। এক অনুষ্ঠানে তিনি হিরো আলমের চেহারা দেখে ক্ষেপে যান, গান তো পরের কথা। কিন্তু এক্স-মন্ত্রী ভাই একটা দামি কথা বলেছিলেন। আলমের জায়গায় এই সব চলতে পারে কিন্তু গুলশানে এইসব চলে না। অর্থাৎ বিষয়টা ওপর তলা আর নিচের তলার। হিরো আলম নিচু আর উনি উঁচু। সমস্যাটা ওই জায়গাতে।

তিন

কথাটা পরিষ্কার। হিরো আলম পরিষ্কার না। সে একটা ফালতু, কুৎসিত, বেসুরা পাবলিক নুইসেন্স। কোথাকার কে? “আইসে বগুড়ার গ্রাম থন- গুলশান থন কত দূর? আর মিডিয়াতে গান ছাড়ে, কথা ছাড়ে। ওইটা মজা লাগে কারণ ওইটা এত বেসুরা!’’ কিন্তু সেটা যদি সুশীল কালচারে আঘাত করে তাহলে তো পাল্টা আঘাত দিতেই হবে। তাই তাকে পুলিশ ডেকে নেয়। তারপর বলা হয়, “এই হিরো, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবি না। এইটা গাইবি না, ওইটা গাইবি না।”  আমাদের পুলিশ অনেক সংস্কৃতি সচেতন। তাই এটা তাদের জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে পালন করে। অবশ্য কেউ কেউ বলেছিলেন, তাকে কাউন্টার টেররিজম আইনে ধরা উচিত ছিল। “তার নাচ, গান ঢং তো সবই হাইল্লা জঙ্গিবাদের মতন।” কিন্তু যেটা হলো, সেটা হবে কেউ ভাবেনি। আসলে হাঁটা পার্টি, পুলিশের এই তৎপরতার পর হয়ে গেল সিএনজি। সবাই তার ইন্টারভিউ করে, টক্ শোতে ডাকে। জাতীয় প্রোফাইল কাকে বলে!

চার

বাংলাদেশের আর্ট কালচার পার্টির কাউকে গোনে না ইন্ডিয়ান মিডিয়া। কিন্তু হিরো আলমকে নিয়ে তাদের বেশ উচ্ছ্বাস লক্ষণীয়। তাকে নিয়ে তারা অনুষ্ঠান করে, আলাপ করে। তারাই বলছে, দুনিয়ায় এই ধরনের গান চালু আছে। যাকে তারা বলেন ‘ক্রিন্জ পপ’ (ঈৎরহমব চড়ঢ়)। মানে বেসুরা গানের ডালি। পশ্চিমা দুনিয়ার কালচারাল বাজার অনেক বড়, সবার জায়গা আছে তাদের জগতে। তাই বেসুরো গান গাইলেই পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে যায় না। আর এটা যদি নিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তো এই দেশের আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে একই পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কিন্তু তাদেরকে ধরার সাহস আছে পুলিশ ভাইদের? না নেই। কিন্তু হিরো আলমকে যায়। কারণ সে সুশীল না, নিম্ন স্তরের গাঁইয়া গায়েন। বলেন, কথাটা ঠিক না বেঠিক?

পাঁচ

এর পর হিরো আলম দেখাল তার নির্বাচনী খেলা। বহু জায়গা থেকে চেষ্টা করা হয়েছে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিতে, কিন্তু পারেনি। আর তার মধ্যে যোগ হয়েছে বিরোধী দলের উৎসাহ। তারা তো মজা নেয়া পার্টি। নির্বাচনে জিতেছে সরকার সমর্থিত দলের প্রার্থী।  আর এক গানের লোক, নাম তানসেন- কিন্তু মাত্র ৯০০ ভোটে হার তার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে হিরো আলমকে। তার অভিযোগ, কেউ পাত্তা দেয়নি। অবশ্য এতে কিছু আসে যায় না। কারণ ভোটে হারলেও, খেলায় কিন্তু জিতে গেছেন হিরো মিয়াই। তাকে আর ঠেকানো যাচ্ছে না। কিন্তু সে কে? কার লোক? নিজের? দলের? পাবলিকের? সমাজের? নিচু তলার? কোনখানে থাকেন হিরো ভাই? দেশ কই? 

ছয়

এই কিসিমের নাচ গান কত হয়? একটু ইউটিউবে যান, দেখবেন “আপনার খালাতো ভাই নাচতাছে আর আপনার ফুপাতো বোন গান গায়। হিরো রে সহ্য হয় না কারণ তার চেহারা সুরত হাইল্লাদের লাহান। গ্রামের চাষার মতো। কোনো সফিস্টিকেশন নাই। ফুকো, দেরিদা নিয়ে আলাপ করে না। সে সুশীল না, তাই হেরা করে পরকীয়া আমরা করি বিবাহ  বহির্ভূত প্রেম। এরে সহ্য হইবো ক্যান? তাছাড়া কুটুর কুটুর কইরা সঞ্চয় পত্র কিনছে এত্ত!  ছিঃ ছিঃ। আমাদের এত কাছে চইলা আইসে?”

সাত

সন্দেহ নাই, হিরো আলম সমাজের নিচু তলার লোক। ওরা বেশি ভদ্র না, গাইতে পারে না আমাদের মতো, আমাদের মতো চক চক করা সুশীল না কিন্তু ওরা উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এরাই বেশি কষ্ট করেছে, কিন্তু ক্রেডিট নিয়েছি আমরা। ওরা এখন আর আমাদের না, এখন গায়ে গতরে পেশি হয়েছে। এদেরই মধ্যে একদল রেমিট্যান্স আনে, চাষ করে। লাইন করতে পারে না, কিন্তু আজকাল এদের লাইন করার দরকারও নাই বেশি। হিরো আলম শুধু ইলেকশন করেছে বলে এক ব্যক্তি তাকে একটা মাইক্রো দিয়েছে। আর সে তা পাবলিকের জন্য দান করে দিয়েছে। এটা কোনো কথা হলো?

আর সরকার তাকে একটা কেস দিয়েছে সম্মান হিসেবে, ওই মাইক্রো জোরে চালানোর অভিযোগে। যে দেশে ট্রাফিক আইন বলে যে কিছু আছে সেটাই জানে না বা মানে না কেউ সেখানে। সহজ কথা “এত দেন ক্যান তারে?” 

উত্তরে বোধহয় সে আর তার কিসিমের মানুষজন দরজায় কড়া নাড়ছে। দরজা খুলতে বলে। খুলবেন? না খুলে  যাবেন কই? এতগুলা হাত ধাক্কা দিচ্ছে!

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //