ভাষার লড়াই ও আমাদের দায়

বাঙালি জাতির সংগ্রামমুখর ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন স্বর্ণোজ্জ্বল এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে। বহতা নদীর মতো যে কোনো ভাষা আপন গতিতে এগিয়ে চলে। তার এই প্রবহমানতা বলা চলে অপ্রতিরোধ্য।

ইতিহাসের নানা ঘাত প্রতিঘাতে, নানা ধরনের মিলনে-মিশ্রণে ভাষা যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি মর্জিমাফিক জবরদস্তিভাবে বদলে দেয়ার অশুভ প্রচেষ্টাও ভাষা সব সময় রুখে দাঁড়ায়। জাতির ইতিহাসে ভাষার এই লড়াকু ভূমিকা বাংলা ও বাঙালির জীবনে পেয়েছে আলাদা মাত্রা।

সেটা এতটাই বিশিষ্ট যে বাঙালির ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্বসভা স্বীকৃতি দিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বাংলা ভাষার এই গৌরব ও মর্যাদার প্রতি, বাঙালির অপরাজেয় সেই লড়াইয়ের স্মৃতির প্রতি আজকের আমরা কতটা সচেতন ও দায়িত্বশীল, সেটা ভেবে দেখা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে এবং সেই সঙ্গে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়সমূহ নির্ণয় করাও প্রয়োজন।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাঙালির ভাষার লড়াই শুরু হয়েছে অনেক আগে, সেই চর্যাপদের কাল থেকেই। হয়তো বাংলা ভাষা তখনো আজকের এই প্রমিত রূপ লাভ করেনি, সবেমাত্র প্রাকৃত থেকে বেরিয়ে এসে আপন চেহারায় প্রতিভাত হয়ে উঠছে; তবু পণ্ডিতেরা ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন জন্ম-আবিল মাখা সেই ভাষাই ছিল বাংলা ভাষার আদিরূপ।

আমাদের ভাষার লড়াই সেই গোড়া থেকেই। পাল রাজাদের পরে সেন রাজারা এসে জনজীবনে যে নিপীড়ন ও জবরদস্তি করে, তারই পরিণতিতে চর্যাপদ এবং পদকর্তাদের দেশান্তর হতে হয়। তাই তো নেপাল থেকে চর্যাপদকে উদ্ধার করতে হয় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে।

মধ্যযুগের কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও বসন্তরঞ্জন আবিষ্কার করেন বাঁকুড়ার এক গোয়াল থেকে। এ সব ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়- কতটা বৈরী পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বাংলা ভাষাকে টিকে থাকতে হয়েছে। বরং মুসলিম শাসনামলেই কিঞ্চিৎ রাজ আনুকূল্য বা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে জনম দুখিনী বাংলা ভাষা, আরবি ফারসিসহ বহু বিদেশি শব্দের মিশেল ঘটার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধি ঘটেছে বাংলা ভাষার; লোকচক্ষুর অন্তরালে অসংখ্য লোককবি রচনা করেন লোকসাহিত্য। 

ভাষার নদী হয়ে ওঠে অনেকটা নাব্য। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে আবার সেই প্রতিক‚লতা। রাজভাষা ইংরেজি শিখে এ দেশেই গড়ে ওঠে দালাল মুৎসুদ্দি শ্রেণি। বাংলা ভাষার স্বচ্ছন্দ বিকাশে তারা সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতা। তারপর পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যমূলক ভাষানীতি বাঙালি জাতিকে রাজপথে নামিয়ে আনে মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছর থেকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর হয় বাঙালি, রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা তখন থেকেই। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাড়িত এবং সৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই বাঙালির ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে। আত্মপরিচয়ের স্বরূপসন্ধানী হয়ে ওঠে বাঙালি। ভাষা আন্দোলন তাই শুরু থেকেই মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাঙালির নিজস্ব ঠিকানা-অন্বেষী হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (২২ ফেব্রুয়ারিও বটে) ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ পরিণতির কথা আমরা বছরের এই বিশেষ দিনটিতে স্মরণ করি, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন অথবা বিশেষ মোনাজাত করি; এমনই সব আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব কর্মকাণ্ডের ফ্রেমে বন্দি করে আমরা অমর একুশকে জাতীয়ভাবে স্মরণীয় (আন্তর্জাতিকভাবেও বরণীয়) একটি দিবসে পরিণত করেছি।

কিন্তু বিশেষ ওই দিবসটির তাৎপর্য অনুধাবনে এবং তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট যত্নবান হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। অথচ একুশের সিঁড়ি বেয়েই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জয় লাভ করেছি। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পেটের ভেতর থেকে অভ্যুদয় ঘটেছে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

সূচনালগ্নেই বাংলাদেশ স্থির করে নিয়েছে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ তথা সংবিধানের চারটি স্তম্ভ। মাত্র পাঁচ দশকের মধ্যেই সেই আদর্শসমূহ থেকে রাষ্ট্র কতটা সরে এসেছে, সেটা যথাযথভাবে উপলব্ধি করাও আজ অমর একুশের দাবি।

আমাদের ভাষা আন্দোলনের রয়েছে ব্যাপক গণভিত্তি, আজ এ কথা বললে অনেকের কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হতে পারে- সাতচল্লিশের দেশভাগের পর এই ভাষা আন্দোলনই সত্যিকারের কথায় সকল শ্রেণির গণমানুষের সম্পৃক্ততায় গণ-আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। সেদিনের এই গণ-ঐক্যই বাঙালিকে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়যুক্ত করে, ছেষট্টির ছয় দফার পতাকাতলে সমবেত করে, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়, সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় নিয়ে আসে, মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দেয়।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা গণ-ঐক্যেই বাঙালির আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটে। স্বাধীনতার পর এই ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। অথচ বছরে বছরে একুশ পালন করেছি। একুশের শিক্ষা কোনো কাজে লাগাইনি।

গভীর পরিতাপের হলেও সত্যি যে ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবময় ইতিহাস একেবারে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লিখে তরুণ প্রজন্মের সামনে যথাযথভাবে  তুলে ধরাও হয়নি (মোটা মোটা গবেষণা গ্রন্থ অবশ্য লেখা হয়েছে), আবার ভাষা আন্দোলনের প্রবহমান গতির সঙ্গে যোগযুক্ত করাও হয়নি।

পূর্বপুরুষের বীরত্বপূর্ণ কীর্তিগাথার সঙ্গে যদি উত্তরপুরুষের পরিচয় নিবিড় এবং আন্তরিকতাপূর্ণ না হয়, তাহলে বহু পূর্বে ঘটে যাওয়া গৌরবদীপ্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিজেকে কেমন করে যোগযুক্ত করবে উত্তরপুরুষ? সেই গৌরবে নিজেকে গৌরবান্বিত ভাববেই বা কী করে? আর পূর্বপুরুষের কাছে উত্তরপুরুষের যে ঋণ, সেই ঋণ যদি কেউ উপলব্ধি না করে, তাহলে তো ঋণশোধের কোনো দায়ই বোধ করবে না তারা।

এখানে এসে একটি উপেক্ষিত বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসও যেমন সম্পূর্ণভাবে অদ্যাবধি সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি, তেমনি ভাষা আন্দোলনেরও আঞ্চলিক ইতিহাস লেখা হয়নি বললেই চলে। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি, জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা করে এ কাজটিতে হাত দেয়া খুবই জরুরি।

দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে এবং মাতৃভাষার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী এবং কতখানি গভীর, সেটা ধরিয়ে দেয়া বড়ই প্রয়োজন। সম্পর্কের সুতোটা চিনতে পারলেই বিশেষ নৈকট্য অনুভব করতে শিখবে মানুষ। অদৃশ্য সেই সুতোয় টান পড়লেই তাদের অন্তরে ভালোবাসা জেগে উঠবে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি, মাতৃভূমির জেগে ওঠার ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের নির্মাতা মানুষের প্রতি।

আর ভালোবাসলে তবেই আসে দায়িত্ব কর্তব্যের কথা, আসে পূর্বপুরুষের ঋণ শোধের কথা। বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে বটে, কিন্তু সেদিনের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যাশা এবং দাবি আরও একটু বেশি। সেই দাবির কথা বিস্মৃত হলে অমর একুশের প্রতি কিছুতেই যথাযথমর্যাদা দেয়া হয় না।

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //