বাঙালি জাতির ঐক্যের সংহিতা

বাঙালি জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। হাজার বছরের সেই ইতিহাস রচিত হয়েছে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ভেতর দিয়ে। সেই ইতিহাসের কোনো কোনো বাঁক ও মোড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও দ্রোহের ঐতিহাসিক ক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ইতিহাস কখনোই ইউরোপের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহের নয়, নির্মমতার নয়, নিষ্ঠুরতার নয়, জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের তো নয়ই।

অধিকন্তু একটি অত্যন্ত বিনয়ী, শান্তিপ্রিয়, অতিথিপরায়ণ ও প্রকৃতিসংলগ্ন একটি প্রাচীন জাতি হিসেবে বাঙালির মহিমা চিরকালই ভাস্মর হয়ে আছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে, তার দুই অংশের মধ্যে এই সংস্কৃতিগত ঐক্য সংহতি ছিল না। শুধু তাই নয়, ধর্মভিত্তিক ঐক্য ছাড়া তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কই ছিল না।

এমনকি ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যেও ছিল অনেক ব্যবধান। জাতিগত এই বিচ্ছিন্নতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে দেশবিভাগের সূচনালগ্ন থেকেই। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির জাতিগত নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, শোষণ ও বঞ্চনা এবং রুক্ষ জীবনাচরণের যে জঘন্য ইতিহাস, তারই নিষ্ঠুরতম প্রতিফলন ঘটিয়ে চলছিল পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের উপর। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য, বিপরীতের ঐকতান সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সৃষ্টিশীল সমাজ বিনির্মাণের মনোভঙ্গি কিংবা সম্পদ ও সুযোগসুবিধার সুষম বণ্টন ও প্রশাসনযন্ত্রের ন্যায়ানুগ ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না।

ফলে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ যে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেছে এবং শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সুবিধা পেয়েছে, পাকিস্তান শাসনামলের সূচনালগ্ন থেকেই সেই সুবিধা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয় এবং তার সূচনা ঘটে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার ভেতর দিয়ে। এই সব ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু যে ন্যায়সূত্রের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বিন্দুমাত্র পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অনুসরণ করেনি। ফলে অনিবার্যভাবেই পূর্ববঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে।

একভাষী বা মনোলেঙ্গুয়াল দেশ হিসেবে সে সময় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল, তার শক্তি সম্পর্কে শাসকগোষ্ঠী তো নয়ই- সূচনালগ্নে আমরাও যথেষ্ট সচেতন ছিলাম না। কিন্তু ক্রমে বাঙালি জাতি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা, জাত-পাত নির্বিশেষে এমন এক ঐক্যের সৌন্দর্যে শক্তিমান হয়ে ওঠে, যার রূপ ইতিপূর্বে বাঙালি জাতি কখনোই দেখেনি। আর সেই ঐক্য ও সংহতির, সেই শক্তি ও সামর্থ্যরে চরম রূপ পরিলক্ষিত হয় ১৯৭১ সালের এই মার্চ মাসে। আর তার পুরোভাগে কিংবদন্তির নেতা হিসেবে অবস্থান করছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ঐতিহ্যময়, চির স্মরণীয় অসাধারণ এক কালখণ্ড। পুরো ষাটের দশক জুড়ে বাঙালি জাতি প্রতিনিয়ত ঐক্যের মহড়ায় নিমজ্জিত ছিল। এক দশকের সেই ইতিহাস সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবহিত আছি। সেই ঐক্য দানা বাঁধতে বাঁধতে অসাধারণ এক জমাট রূপ পরিগ্রহ করে মার্চ মাসে।

বিশেষ করে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি শব্দ বাঙালি জাতির জন্য বিস্ময়কর প্রেরণার মহাকাব্য হয়ে ওঠে। এবং তারপর আর আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি দেহে এবং মনে, চেতনায় ও বিশ্বাসে এমন এক ঐক্যে সমবেত হয়, যার কোনো তুলনা চলে না। সেই ঐক্য ও শক্তি গোলাবারুদের চেয়ে, সামরিক শক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ফলে অস্ত্রশস্ত্রহীন, গোলাবারুদহীন, প্রশিক্ষণহীন অতি নিরীহ ও সংস্কৃতিমনস্ক একটি জাতি হয়ে যায় শতসহস্র বোমার বিস্ফোরণের মতো। 

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় এক যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত। মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা জয়ী হই। হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীন ও সার্বভৌম এক জাতিরাষ্ট্রের অধিকারী হই আমরা। 

কিন্তু আজ স্বাধীনতার বাহান্ন বছর পরে আমরা কোথায় আছি? অর্থনীতি, মানব উন্নয়নের বিচিত্র দিক থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের সেই অগ্রযাত্রা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য বিস্ময়কর। কিন্তু যদি জাতিগত সেই ঐক্যের কথা বলি; রাজনীতি, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষের সমবেত সৌন্দর্য ও শক্তির কথা বলি;  আমাদের ঐক্য ও সংহতির কথা বলি; তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায়? এই বাহান্ন বছরে কতভাবে যে আমরা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

একটি দেশে বিচিত্র রাজনীতি, মতাদর্শ, ধর্ম-বর্ণ-পেশার মানুষ থাকবে এবং এই থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৈচিত্র্যের মধ্যে যদি ঐক্য সাধিত না হয়, তাহলে তা কখনোই কোনো জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। গত বাহান্ন বছরের নানা বাঁকে ও মোড়ে যে স্বৈরশাসন পরিচালিত হয়েছিল, তার আদর্শই ছিল বিচ্ছিন্ন করা, আলাদা করা, দুর্বল করা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহকর্মীদের হত্যার ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে অশুভ সূচনা করেছিল, তার ভেতরে কোনো অবস্থাতেই ঐক্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না।

আর সেই অনৈক্যের, দুর্বল করার, হত্যা ও ধ্বংস করার রাজনীতি ক্রমান্বয়ে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে, বিহ্বাল করেছে। আজ বাহান্ন বছর পরে এসে আমাদের বিচিত্র উন্নয়নের আখ্যান রচিত হলেও কিছুতেই বলতে পারব না যে, ষাটের দশকের বিস্ময়কর আন্দোলনমুখর দিনগুলোর মতো এবং পরিশেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতো, রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসের মতো আমাদের মধ্যে জাতিগত ঐক্য অক্ষুণ্ন আছে। 

কিন্তু জাতিগত ঐক্য ছাড়া মহৎ কোনো অর্জন সম্ভব নয়। বিশেষ করে উন্নয়ন ও অর্জনকে টেকসই করার জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি চেতনার, বোধের, বিশ্বাসের, আস্থার। এবং এর ভেতর দিয়ে স্থাপিত হয় বিপরীতের মধ্যে ঐকতান। এই ঐকতান ছাড়া সৃষ্টিশীল সমাজ বিনির্মাণও সম্ভব হয় না। 

সুতরাং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে আকাশচুম্বী স্বপ্নের পথে আমরা হাঁটছি, সেই স্বপ্ন আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে যখন আমরা জাতিগত ঐক্যের বাতাবরণে নিজেদের স্থাপন করতে পারব। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে এনে রাজনীতি, মতাদর্শ, বিচিত্র শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্য সংস্থাপিত করতে পারি, তা হলে আমরা একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারব। 

লেখক ও অধ্যাপক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //