তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

২০০২/০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে দেশের একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকার মতামত কলামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এমন রমরমা যুগও নয়, কিন্তু পত্রিকা আমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই আর্টিকেলের নিচে ব্যবহৃত ইমেইল অ্যাড্রেসে প্রায় অর্ধশত মেইল এসে হাজির। যেখানে আমার লেখা বিষয়ে বিশেষ কোনো কথা নেই বরং আমি একজন নারী এ কারণেই তারা শুধু পরিচিত হওয়ার জন্য মেইল করেছে বলে মনে হয়েছিল।

এর পর বছর দুয়েক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কোনো একটা বিষয়ে মন্তব্য করায়, একটি নির্দিষ্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী নেটিজেনদের ওই মন্তব্য পছন্দ না হওয়ায়, তারা ভার্চুয়াল জগতে আমাকে নানাভাবে হেনস্তা করার কৌশল বের করে। যে কারণে আমাকে প্রোফাইল লক করে রাখতে হয়েছিল।

তখন মনে প্রশ্ন জেগেছিল ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে নারীর সমতা কতটুকু আর সীমাবদ্ধতাই বা কতটা! এ বিষয়ে সম্প্রতি বিবিসিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় বেশিরভাগ নারী বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোনো মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিংবা পাবলিক পোস্টে কমেন্টের ক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়েন, তাদেরকে নানা বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন পুরুষ যত সহজে তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন, একজন নারীও কি সেভাবে পারেন? বাংলাদেশে নারীদের অনেকেই উত্তরে বলছেন ‘না’। 

এই ‘না’-এর কারণ অনেক গভীরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ভার্চুয়াল জগৎ নারী হয়রানির এক উন্মুক্ত ফাঁদ। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির অসচেতনতা, মানসিক বিকৃতি এবং কট্টর পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কাজ করে।

তারা নারীকে সরব নয় বরং অর্নামেন্টাল পিস হিসেবে দেখতে চান। একজন নারী তিনি যে বয়সেই হোন না কেন তাকে সমাজে এখনো যৌনবস্তু হিসেবে বিচার করা হয়। এবং সুযোগ পেলেই এ সমাজ নানা হয়রানি করতে তাদের প্রতি উন্মুখ হয়ে থাকে। এখানে কোনো নারী সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত দিলে, যারা এর বিরোধী পক্ষ, তারা নারী পুরুষ নির্বিশেষে ওই নারীকে ট্রল করতে, বাজে মন্তব্য করতে ছাড়ে না। এবং পরে সে বা তিনি যদি কোনো নিরীহ পোস্টও দেন বা ছবি পোস্ট করেন তাহলেও তাকে হাহা রিঅ্যাক্ট দিয়ে বা কটু মন্তব্য করে হেনস্তা করা হয়। 

সাধারণত দেখা যায় কোনো নারীর একটি পোস্ট ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা কেউ একজন কপি করে সেটি শেয়ার দিয়েছে এবং সঙ্গে বাজে কিছু মন্তব্য যোগ করেছে। পরে সেখানে আরও অনেকে বাজে কমেন্ট করেছে যা খুব অপমানজনক। এটা কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি হয়, ছেলেদের ক্ষেত্রে হয় না।

অনেক নারীই বলে থাকেন, তারা যে কোনো মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিংবা পাবলিক পোস্টে কমেন্টের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়েন, নানা মন্তব্যের শিকার হতে হয় তাদের।

রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সরব ভ‚মিকা নিলে সেখানেও পুরুষদের দ্বারা বাড়তি আক্রমণের মধ্যে পড়তে হয় মেয়ে বলে। এ কারণে নারীদের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে গেলে রীতিমতো চিন্তা-ভাবনা করে লিখতে হয়।

একটা সময় হয়তো একজন অনেক বিষয়ে লিখতে পারতেন কিন্তু এখন তাকে পাঁচবার ভাবতে হয়। চিন্তা করতে হয় কী লিখবেন, আবার কে দেখবে, কী ভাববে? রাজনৈতিক কিছু লিখলে সেখানে হয়তো কেউ এমন কমেন্ট করবে যা ওই ব্যক্তিকে আহত করছে। হয়তো তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন সেটা কানেক্ট করতে না পেরে নেটিজেনরা তাদের চিন্তা ওই ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়ে চলেছে এর নানারকম জটিলতা। আর এই জটিলতার প্রধান শিকার নারী বলাই বাহুল্য।  

বাংলাদেশের সরকারি হিসেবে যে আট কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন তার বড় অংশই নারী। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্মুক্ত ফোরামে পুরুষদের যত জোরালোভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে দেখা যায়, সেই তুলনায় নারীদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এর প্রধান কারণ নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। 

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যারা নারীদের প্রতি এ ধরনের আচরণ করে, তাদের মধ্যে একটা মনোযোগ আকর্ষণের আলগা চেষ্টা থাকে। তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের সমস্যা থাকে। যেভাবে তারা বড় হয়েছেন, সেখানে অর্থাৎ তাদের সামাজিকীকরণেও সমস্যা রয়েছে। প্রতিহিংসাপরায়ণতাও কাজ করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। যেমন কোনো নারীর মতামত পছন্দ হলো না, এমনও দেখা যায় প্রতিহিংসা বশত কারো ছবি হয়তো ফটোশপ করে পর্নো তৈরি করে নেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। 

প্রায় সব বয়সী নারীই ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে হেনস্তা বা যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হয়রানির অংশ হিসেবে নারীর অনুমতি ছাড়া ছবি, ভিডিও, ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও প্রচার, শরীর, পোশাক নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের হুমকি, ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, শারীরিক মিলন, বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ নিত্যনৈমিত্তিক। 

তবে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান না থাকলেও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে যে আইনটি রয়েছে এর ২৯ ধারায় মানহানির বিচার করা যায়। এ ধারা অনুযায়ী কেউ যদি কাউকে এ ধরনের মাধ্যমে কোনো তথ্য প্রকাশ করে অপমান, অপদস্থ বা সম্মানহানি করতে চায় তাহলে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। 

২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় যে সমস্ত বিষয় মানহানিকর, সেই তথ্য যদি প্রচার এবং প্রকাশ করে থাকেন, তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবেন বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে। সেটা ছাড়া দণ্ডবিধি ৫০০ ও ৫০১ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়। এতে দুই বছরের কারাদণ্ডের সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। 

যদিও বেশিরভাগ নারীই এর আইনি প্রতিকার কীভাবে নিতে হয় তা জানেন না বা সেদিকে অগ্রসর হন না। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, মেসেঞ্জার, টুইটার, লিংকডইন, টিকটক, ডিজিটাল শিক্ষা-মাধ্যম (জুম, মিট, টিম) প্রভৃতি মাধ্যমে নারীদের বিভিন্নভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে জেন্ডার ইকুয়ালিটি। বর্তমান সময়ের একটা বড় যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর এমন নাজুক অবস্থান এই সমতাকে কতটা প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে, বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নারী কতটা বাক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে? এই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। 

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //