‘মৃত্যু কারে কয় তখন বুঝতাম না’

উনিশশ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ থেকে ছাত্র, শিল্পী, পেশাজীবী যে যেভাবে পেরেছে পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসে শত্রুর হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। মুক্তিযুদ্ধের এই মাসে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নবজাগরণ সৃষ্টি সবচেয়ে বড় বিষয়।

পাকিস্তানি শাসকরা চেয়েছিল বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধ।সব হবে পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাকেন্দ্রিক। তাহলে টিকে থাকবে তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো।

বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে (কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস)। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বদলে যায় পাকিস্তানিদের স্বপ্নের সাজানো বাগান। তারপর ২৫ মার্চ বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে শুরু হয় গণহত্যা। অপারেশন সার্চলাইট নামে এই গণহত্যায় ঢাকায় একদিনে মারা যায় ৩০ হাজার মানুষ।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ৯ মাস ধরে সব রীতি-নীতি, আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বাঙালিদের হত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন করলেও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। 

এদেশের মাটি কত নাম না জানা মানুষের রক্ত-ঘামে, অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে আছে, তার খবর কজন রাখে? এরকমই একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব সরদার। কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার কমলেশ বেদজ্ঞের একনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনকে সঁপে দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার কাছে।

কমপক্ষে ২৫টি যুদ্ধে বীরোচিত ভুমিকা নেওয়া এই বীর যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। মিডিয়াতে ডাকলেও আসেন না। সম্প্রতি কোটালীপাড়ায় অনেক খুঁজে তার সঙ্গে দেখা হয়-তার ছেলে পলাশ সর্দারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্যাফে ’৭১-এ তার কাছে শুনি সিকির বাজার যুদ্ধের বর্ণনা-

“সেদিন সূর্যের আলোর প্রখরতা ছিল। আমরা ১০/১২ জনের একটি দল বর্তমান কুশলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কালু চেয়ারম্যানের বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সিকির বাজার হয়ে পয়সার হাট আসতে পারে। হেমায়েত বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড কমলেশ বেদজ্ঞের নেতৃত্বে আমি (তৈয়াবুর রহমান সরদার), শহীদ গোলাম আলী, মোহন সর্দার, গোকুলসহ আমরা সিকির বাজারের উদ্দেশে নৌকাযোগে রওয়ানা হই।

আমাদের নৌকা ঘাঘর বাজার আসলে গোডাউনের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটো লঞ্চ দেখতে পাই। ইতিমধ্যে সিকির বাজারে খবর হয়ে গেছে মেলেটারি আসছে। চারদিক সুনসান নীরবতা। বর্তমান সিকির বাজার স্কুলের বিপরীতে দেবীদেশ সাহার বাড়িতে একদল মুক্তিযোদ্ধা থাকত। আমরা সিকির বাজারে নেমে সেখানে যাই। গিয়ে দেখলাম ৪/৫টা রাইফেল পড়ে আছে। চুলায় এক পাতিল মাংস জাল হচ্ছে- যারা ওখানে ছিল তারাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কথা শুনে পালিয়ে গেছে। তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েও লাভ হয়নি।

বিভিন্নভাবে খুঁজে মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে যখন সিকির বাজারের রাস্তায় দাঁড়ালাম তখন রাত প্রায় দশটা। আমরা সিকির বাজারের রাস্তায় ভোরের অপেক্ষায় সময়টা কাটিয়ে দিলাম। আমাদের ধারণা ছিল সকালে পাকিস্তানি সেনারা এদিকে আসবে। আমাদের সঙ্গে যে ১০ জন ছিল তার থেকে ৪ জন যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নিলো। অতঃপর ফজরের আজান দিলে আমরা নির্ধারিত পজিশনে চলে যাই। ৬ জনকে তিনটি ট্রেঞ্চে বসালেন যুদ্ধের কমান্ডার কমলেশ বেদজ্ঞ।

এর মধ্যে সিকির বাজার ট্রেঞ্চে ২ জন গোলাম আলী-মোহন সর্দার, মোল্লার বাড়ির পুকুর পাড়ে গোকুল-মহর আলী, আর কানাই গৌতমের বাঁশঝাড়ের ভেতরে ট্রেঞ্চেকমলেশ ও আমি ট্রেঞ্চে বসেছি। খুব সকালে পাকিস্তান আর্মির প্যারেড এসে সিকির বাজার বটগাছের কাছে দাঁড়ায়। কারণ তখন ব্রিজ ছিল ভাঙ্গা। কাল বিলম্ব না করে আমার ও কমলেশদার রাইফেল গর্জে ওঠে। চলে যুদ্ধ। তোলপাড় করা সে যুদ্ধ।

বাঁচা-মরার চিন্তা না রেখে হানাদারদের মোকাবেলায় আমরা ভয়ংকর থেকে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিসেনাদের গুলিতে কেঁপে ওঠে সিকির বাজার এলাকা। আক্রমণে পাকিস্তান আর্মি টিকতে না পেরে মনিমোহন চৌধুরীর বাড়ির (বর্তমান তহশীল অফিস) পথ ধরে শীল বাড়ি দিয়ে ঢুকে আমাদের পাকড়াও করার চেষ্টা করে।

আমি ও কমলেশদা বিষয়টা বুঝতে পেরে ধোপা বাড়ির পাশ দিয়ে অমৃত লাল সাহার পুকুরের পাশ দিয়ে পিছু তাকাতেই দেখি পাকিস্তানি সেনারা আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা বিভিন্ন পথ দিয়ে ঘুরে আবার সিকির বাজারে আসি। এসে দেখি সিকির বাজার ট্রেঞ্চের যোদ্ধা গোলাম আলী শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানি বর্বরেরা তার উরুর মাংস কেটে নিয়ে গেছে। তার শরীরে বেওনেট চার্জের সব দাগ। আমরা তার লাশ উদ্ধার করি। এ সময় জানতে পারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫/২০ জন ওই যুদ্ধে মারা গেছে।”

যুদ্ধের এ কাহিনি বলতে বলতে আবার যেন একাত্তরের দিনে ফিরে গিয়েছিলেন ৭৬ বছর বয়সী বীরযোদ্ধা তৈয়ব সর্দার। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের ক্ষেত্রে কোনো আপস নেই। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় মৃত্যু কারে কয় চিনতাম না।” ডহরপাড়া গ্রামের এই তরুণ ১৯৭১ সালে ছাত্র থাকাকালে ঘাঘর বাজারে একটা বইয়ের দোকান করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার পর দোকান বন্ধ করে গোপালগঞ্জ কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে তারও আগে তার আনসারের ট্রেনিং ছিল। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা করেছে; এসব ব্যাপারে তিনি আনন্দিত। কিন্তু তার দুর্ধর্ষ সব যুদ্ধের কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার কমলেশ বেদজ্ঞর নাম মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় নেই বিষয়টি তাকে পীড়া দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে তিনি আর কোথাও যাননি। সুবিধা, চাকরি কিছুই নেননি। চার ছেলে তৈয়াবুর রহমান সরদারকে এলাকাবাসী স্পষ্ট কথার জন্য বিশ্বাস করে-এটাই তার বড় পাওয়া বলে তিনি মনে করেন।

সাংবাদিক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //