চাঁদের উজ্জ্বলতা-কলংক ও সরকারের অর্জন-ব্যর্থতা প্রসঙ্গ

তিপ্পান্নতম স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর-আলশামস দালালবাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতনের সঙ্গে সেই দিনগুলোর প্রত্যাশা নিয়ে ভাবছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমান দিনগুলোর কতই না ফারাক! তখনকার প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া, দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সময়ের ব্যাপারমাত্র এবং স্বাধীনতা এলে দেশ ও জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি চলে আসবে হাতের মুঠোয়, এমনটাই ছিল ভাবনা।

আর এখন! প্রত্যাশার পরিধি ছোট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশ ও জনগণের সার্বিক মুক্তি এখন দূরের বাজনা হলেও শহীদদের রক্তরঞ্জিত চার মূলনীতির বাস্তবায়নের কথা ভাবতেই হয়। এটা তো দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট, স্বাধীন দেশে বিশেষত বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তি বিশাল। কিন্তু রাজনৈতিক আড্ডায়-আলোচনায় সমস্যা-সংকটগুলোই উঠে আসে বেশি। তাই আলোচিত ইস্যুগুলোর মূলে সমাধান কীভাবে হবে তা নিয়েই ভাবনা আবর্তিত হয়। 

ইস্যু আসে, ইস্যু যায়। কোনোটা আপাত সমাধান হয়, কোনটাবা পাথরচাপা পড়ে। আলোচিত সমস্যা-সংকটের সার্বিক সমাধান কীভাবে  হবে, তা ভাবতে পারি না। কোভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বকে এমন গভীর সমস্যা-সংকটের মুখোমুখি করেছে, যা নিয়ে ভাবলে সমস্যা-সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কূলকিনারা পাই না।

স্বাধীনতা দিবসে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে বাসায় বসে বসে কয়েক দিনের আলোচিত ইস্যুগুলোকে নিয়েই ভাবছিলাম। রোজায় দাম বেশি ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি, সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বিপজ্জনক মিথেন গ্যাসে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়, পুলিশ হত্যার আসামি আরাভ খানের সম্পদ নিয়ে দেশ থেকে পলায়নের রোমাঞ্চকর কাহিনি, সিআইডি কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে ডিআইবির মুক্তিপণ আদায়, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা, বিদেশে সম্পদ পাচার, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, আগামী নির্বাচন কেমন হবে ইত্যাদি আলোচিত ইস্যুগুলো নিয়েই ভাবনার জগৎ আলোড়িত হচ্ছিল।

এমতাবস্থায়ও ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে ক্রিকেটে সিরিজ জয় ও কাবাডিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশিয়াডে পদক পাওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখাটা ছিল স্বস্তির দিক। এসবই স্বাধীনতার ফসল এবং যুবশক্তির আত্মপ্রকাশ, যা স্বপ্ন-প্রত্যাশা জাগানিয়া। এ নিয়ে বিদগ্ধ মহলে খুব একটা আলোচনা হয় না। সর্বোপরি ৫২তম স্বাধীনতা দিবসের আগে তৃণমূলের মানুষদের বিশাল ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রাপ্তি নিয়ে কেন যেন আলোচনা সামনে আসে না।

স্বাধীনতা দিবস এবং ঈদোৎসব সামনে রেখে গত ২২ মার্চ আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ৩৯ হাজার ৩৬৫টি আধাপাকা বাড়ি গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মধ্যে হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা-এই ৭টি জেলার সব উপজেলাসহ ১৫৯ উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। এর আগে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাকে এমনটা ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ৯টি জেলার সব উপজেলা ও ২১১টি উপজেলা গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত হলো।

এটা বোধকরি সকলেই অবগত আছেন যে, সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশে ভূমিহীন-গৃহহীন ক্ষেতমজুরের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা দারিদ্র্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে বলতে থাকেন, বাংলাদেশ রয়েছে আগ্নেয়গিরির ওপরে, যে-কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটবে। এই প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠে ক্ষেতমজুর সমিতি এবং তাদের নিজস্ব দাবিতে আন্দোলন। স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে এই সংগঠনের ব্যানারে ক্ষেতমজুররা গ্রামে-গঞ্জে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ওই দিনগুলোতে সংবিধান প্রদত্ত ৫টি মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রাপ্তি সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে আসে। সংগঠন-আন্দোলনের কাজে গ্রামে গ্রামে অনবরত ঘোরা ও তাদের সঙ্গে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে মনে হয়, সব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বড় ছিল বাসস্থান না থাকা। এখন তারা তা পাচ্ছে। কেবল বাসস্থানই নয়, পাচ্ছে বিদ্যুৎও। কেবল তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি নয়, গ্রাম-গঞ্জে গেলেও অনুধাবন করা যাবে, অন্য চারটি মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আমাদের জাতির অর্জন নিঃসন্দেহে হিসেবে নেওয়ার মতো।

লেখার বিরতি নিতেই দেখলাম, বিটিভিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রচার হচ্ছে, তাতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন প্রকল্পে বাড়ি পাওয়া মহিলা ও বালিকারা, খুবই তৃপ্ত তারা। কাকতালীয় কি না জানি না, ওই সময়েই পত্রিকার খবরে জানলাম, যোগাযোগের অসুবিধার কারণে পদ্মার দুর্গম চরে দুই বছর আগে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫১০টি ঘরে কেউ থাকে না।  মৌলভীবাজারে ১২টি গৃহ ফাঁকা। এই প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশ হওয়ার খবর ইতিপূর্বেও পত্রিকা পাঠে জেনেছি।

আমাদের দেশে সরকারি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা যে পর্যায়ে রয়েছে, ব্যক্তি ও চেইনজাত সমষ্টিগত পর্যায়ে দায়িত্বশীলতা ও দুর্নীতির যে হাল; তাতে উল্লেখিত ধরনের নেতিবাচক কিছু হবে না, এমনটা বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে দুই দিক থেকে বিবেচ্য হচ্ছে দুটি, প্রথমত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে গৃহহীন নাগরিকদের বহুদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না? দ্বিতীয়ত খাজনার চেয়ে বাজনা প্রবাদের মতো অনিয়ম-দুর্নীতি লাগামছাড়া হলো কি না। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বলা যায়, প্রথমটার উত্তর হ্যাঁ। দ্বিতীয়টার উত্তর না। 

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এমনটা দেওয়ায় ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই যে, দুর্নীতি ও অনিয়ম কিংবা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটি-দুর্বলতার পক্ষে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। সর্বোপরি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সেবাপরায়ণতা সরকারি প্রশাসনের মূল নীতি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সর্বপ্রকার হয়রানি দূর করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বলাই বাহুল্য, কোনো একটা বিশেষ ইস্যুতে জনগণের প্রাপ্তি বিবেচনায় সরকারের সাফল্য তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে যদি ত্রুটি, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা ওঠে, সমালোচনা হয়; তবে তা সরকারের চলার পথের পাথেয় হয়ে ওঠে। সাফল্য-ব্যর্থতা পাশাপাশি না তুলে যদি কোনো একটা পাথরচাপা দিয়ে অন্যটা কেবল সামনে আনা হয়, তবে তা হবে একদেশদর্শিতা। তাতে ঈপ্সিত ফললাভ হওয়া অসম্ভব।

অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এক্ষেত্রে বলতেই হয়, দলভুক্ত ব্যক্তিরা একদেশদর্শী হতেই পারে, কিন্তু সুশীল সমাজ, যারা জাতির বিবেক, তাদের এমনটা হওয়া মানে জাতির জন্য বিপদ ডেকে আনা। তবে দলভুক্ত ব্যক্তি, নেতা-কর্মী যিনি-ই হন, অন্ধ হওয়ার বিপদ রয়েছে। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়েই বোধকরি ২০০৮ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমতের অধিকার দেওয়া হবে।’ ‘কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয়’সহ এ বিষয়ে কতটুকু কী করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে মাঝে মাঝে সংসদে যে সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ পায়নি, তা কিন্তু নয়।

৮ মার্চ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়কে শৃঙ্খলা আনা, দুর্ঘটনা কমানো ও যানজট নিরসন নিয়ে প্রশ্ন তুললে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কর্মে ও কর্তব্য পালনে একজন মানুষ কখনোই পারফেক্ট নন। চাঁদেরও কলংক আছে, এর জন্য কি চাঁদের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে? কাজ করতে গেলে কিছু ব্যর্থতা তো থাকবেই। সফলতার মধ্যে ব্যর্থতা আছে, শতভাগ সফলতা সম্ভব না।’

কথাটা খুবই সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে উত্থাপন করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় নেতা ওবায়দুল কাদের। এই অবস্থান গ্রহণ করায় দেশবাসী নিঃসন্দেহে তাকে অভিনন্দিত করবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে, চাঁদের উজ্জ্বলতা ও কলংক নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করলেই যেহেতু প্রকৃত চাঁদকে চেনা যায়, চাঁদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়; তেমনি সফলতা সামর্থ্য ও অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা আলোচনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে হচ্ছে কি?

এই প্রশ্ন সামনে রেখে সরকার সমর্থক মহলে এমন কথা উঠতে পারে যে, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করলে বিরোধী দল লুফে নেবে এবং তা বুমেরাং হবে। বাস্তবে সফলতা-অর্জন সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে তুলে ধরে যদি দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা আলোচনা করা যায়, তবে এর উল্টো হবে। তখন সফলতা-অর্জন বলা ছাড়া বিরোধী দল যদি কেবল ব্যর্থতার কথা বলে তবে  জনগণ তাদের আরও প্রত্যাখ্যান করবে। সর্বোপরি উজ্জ্বলতা ও কলংক একসঙ্গে আলোচিত হলে দল ও সরকার ক্রমে কলংক মোচন করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠবে। সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য এই দুই কাজ একত্রে যতটুকু অগ্রসর করতে পারবে, তা দিয়েই নির্ধারিত হবে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক কল্যাণ-রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ কতটা অবদান রাখতে সক্ষম হবে।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //