বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা সৈনিক ও ফিরে দেখা চর্চা

মোস্তফা মহিউদ্দিন ভাই-ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের একটু সিনিয়র। একটি স্মৃতিগ্রন্থ লিখেছেন তার সময়কার শিল্পী সাহিত্যিকদের আড্ডা নিয়ে। এরা সবাই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন আড্ডার সদস্য। এর মধ্যে দুটি আড্ডার কথা তিনি বিশদভাবে বলেছেন। একটি শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, যেটা ছিল কলা ভবনের ভেতর লাইব্রেরির আশেপাশে। অন্যটি ‘রেখায়ন’, যেটি একটি ছবি আঁকা শিল্পের বাণিজ্যিক দোকান। এটি অবস্থিত ছিল শাহবাগ এলাকায়। এ দুই স্থানে আসত সেই সব মানুষ, যারা দেশ স্বাধীনের পর নির্মাণ করেছেন শিল্প সাহিত্য চর্চার কাঠামো।

দুই 

লেখক বিবরণের মাধ্যমে বলেছেন সেকালের ভার্সিটিকেন্দ্রিক তরুণ জনশীল মানুষদের জীবনযাত্রার কথা। আরও গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বহু মানুষের কথা বলেছেন, যতদূর সম্ভব নাম উল্লেখ করেছেন যারাই ছিল তাদের। কাউকে বাদ দিতে চাননি। আজ এদের মধ্যে অনেকেই হারিয়ে গেছে, মৃত অথবা সক্রিয় নন। প্রয়াত কথাটা বারবার আসে। এই বইয়ের মাধ্যমে তারা সবার কাছে জানান দিতে পারবেন তারা ছিলেন।

তিন 

মোস্তফা মহিউদ্দিন ভাইয়ের বইটা আসলে স্মৃতিগ্রন্থ নয়, ইতিহাস চর্চা। কারণ তার উদ্দেশ্য সময়কে ধরা। ২০২৩ সালে এসে ওই অতীত কেবল সুদূর নয় অনেকটাই কল্পনা করা কঠিন। আমাদের দেশে বেশিরভাগ হলো রাজনৈতিক বা সামাজিক ইতিহাস, পণ্ডিতি ধারায় লেখা, পাঠকের আগ্রহ কম। এর কারণ একই-রাজনীতি। আমরা অতীতকে ডেকে আনি গালি দিতে বা মহান বানাতে। তাই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতি আমাদের আগ্রহ কম, প্রায় নেই। কিন্তু মানুষের আগ্রহ প্রবল এটা নিয়ে। ফেসবুকে অনেক গ্রুপ আছে যেখানে সেই সময়কার ছবি ও স্মৃতিচারণ থাকে। এই বইতে একটি বিশেষ অতীত যেটা বাইরের মানুষের জানার কথা নয় সেটা তিনি জানালেন লিপিবদ্ধ করে। বিষয় একটি সময়ের শিল্পী সাহিত্যিকদের আড্ডার জীবন।

চার 

রেখায়ন দোকানটা একটা চরিত্রের মতো যেন। মালিক তো বটেই, রাগিব আহসান ছিলেন চিত্রশিল্পী, ঈদের কার্ড ডিজাইন করে, ছাপিয়ে বিক্রি করতেন অন্য কাজের সাথে। কিন্তু তিনি আর তার দোকান হয়ে উঠেছে একটি প্রজন্মের সাহিত্য, শিল্পচর্চা কেন্দ্র। একটি সাধারণ ‘সাইনবোর্ডের’ দোকানের এই রূপান্তর আসলে বলে সমাজের ইনফরমাল প্রকাশ কতভাবে হতে পারে, হয়। সন্ধ্যাবেলাটা আর সময় থাকে না, পরিণত হয় কালে।

মহিউদ্দিন ভাই খুব সরল সহজভাবে এই কথাগুলি বলেছেন। তার কাছ থেকেই জানা গেল যে রেখায়নের রাগিব এখন মার্কিন দেশে থাকেন, কদিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন, আড্ডা দিয়েছেন সেই পুরনোদের সাথে। তিনি এখন আর ব্যক্তি নন, সংস্কৃতির ইতিহাসের অংশ। আর যারা সেখানে আড্ডা দিতেন, তারা কি আড্ডা সৈনিক? আজকাল তো সবাই পেশার পরিচিতির পাশে ‘সৈনিক’ তকমাটা লাগায় যেভাবে, তাই বললাম।

পাঁচ 

কয়েকটি স্মৃতি খুব মজার, এমনকি কষ্টের পটভ‚মিতেও। এক প্রয়াত কবির কথা বলছেন মাসুদ আহমেদ মাসুদ-যিনি প্রেমে দাগা খেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান। তাকে নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি উক্তি বইটিতে আছে। গুণদা তাকে বলছেন যে মাসুদ এক ছ্যাঁকা খেয়ে এই অবস্থা আর তারা/তিনি তো চারিদিক থেকে কত খেয়েছেন, এসব কিছু না। যেভাবে উক্তিটা আছে সেটা কবি গুণকে খুব ভালোভাবে সামনে আনে, তার চরিত্র, প্রকাশ, মেজাজ। তিনি যে কত প্রাণবন্ত ছিলেন সেটা তাকে যারা ওই কালে দেখেছে তারাই বলতে পারবে। কবিকুল সেই কালের প্রতীক। যেমন প্রতিভাবান, তেমনি উচ্ছল, উচ্ছৃঙ্খল। তিনি ও তারা একটি অসাধারণ দশকের পোর্ট্রেট। 

ছয় 

কিন্তু এই কবি মাসুদ আহমেদ মাসুদও একটি যুদ্ধপরবর্তী জীবনের বাস্তবতা। যে কোনো কারণেই হোক মানসিক সমস্যা হচ্ছিল অনেকের। যাকে বলে ‘উন্মাদ’ তা নয়, তবে জীবন ছিল প্রচণ্ড অস্থির, অনিশ্চিত। এছাড়া ছিল যুদ্ধের আগুনের আঁচ। ওইভাবে ট্রমামুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়নি অনেকেই। এর মধ্যে আসে গাঞ্জা, যেটা বরং ছিল অনেক নিরাপদ, কিন্তু তারপর আসে ড্রাগস, ট্যাবলেট, গুল্লি-অনেকেই খেত। মদ তো সবার পকেট সামাল দেবার ক্ষমতার বাইরে ছিল। অবশ্য ‘বাংলা’, ‘চোলাই’ ও আরও বেশ কিছু স্থানীয় এডিশন চালু ছিল। সেটা আসক্তি এনেছে, নতুন দেশ নতুন বিরূপ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টার বেশি কিছু ছিল না, অনেক দাম দিয়ে কেনার চেষ্টা। কবি মাসুদ বরিশালের মানুষ ছিলেন, সেখানেই ওনার মৃত্যু হয়।

এই প্রসঙ্গে লেখক জানালেন আর একজনের কথা নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু। মনে পড়ল তাকে শেষ দেখেছিলাম রাস্তায় খালে পায়ে একটা ঠেলা গাড়ি ঠেলছেন, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। শ্রমিকগুলো কিছু বলেনি তবে তিনি ধরে ছিলেন বলা যায়, ঠেলার শক্তি তার আর ছিল না তখন। এই ইতিহাসে সবার লেখায় জায়গা হয় না, হয়নি।

সাত 

এটি বুক রিভিউ নয়, এটি একটি সময় কালকে নিয়ে আড্ডা হচ্ছিল। তবে আমি লেখককে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। কারণ আমাদের সাধারণ স্মৃতিচারণের বাইরে গিয়ে তিনি যে কাজটি করেছেন সেটি হলো একটি আড্ডার ইতিহাসের মাধ্যমে একটি সময়কে উপস্থিত করা। আমরা আড্ডাপ্রিয়, কিন্তু তার ইতিহাস লেখার কথা ভাবি না। তিনি করেছেন। আমরা তার অংশগ্রহণকারীদের গুরুত্ব দেই না, তিনি তাদের চিত্র যেভাবে এঁকেছেন, তাতে তারা সাহিত্যের সীমা পার হয়ে সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে যান, বিশেষ এক পরিসরের। আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অনেক অভাব, সেই ঘাটতিটা এতে একটু মিটবে। অনেকেই বিভিন্ন সময় পার হয়েছেন এই পঞ্চাশ বছরে। তাদের, যাদের ক্ষমতা আছে, লেখা উচিত।

আট

কবি রফিক আজাদের একটি স্মৃতি। তিনি দেশ স্বাধীনের পর পরই টাঙ্গাইলের এক কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সারাদিন স্যার স্যার শুনতে হতো। তার মতো মানুষের জন্য এটা কষ্টকর বিষয় ছিল। তাই রাতে, কাছের এক মাঠে গিয়ে কিন্তু প্রাণ খুলে মুখ খিস্তি করতেন নিজের মাথাকে নরমাল রাখতে। এমন মানুষদেরকে সামনে আনার জন্য মোস্তফা মহিউদ্দিন ভাইকে ধন্যবাদ।

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //