তুমি বন্ধু কালা পাখি

পাকিস্তানের যে খবরটি সারা বিশ্বের মানুষের ভাবনার জগৎকে নাড়া দিচ্ছে তা হলো পাকিস্তানের অনিবার্য দেউলিয়াত্ব। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার খবর অনুযায়ী গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সিয়ালকোট শহরে একটি কলেজে ভাষণ দানকালে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, পাকিস্তান এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে অর্থাৎ দেশটির দেউলিয়া হতে আর বাকি নেই। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা দেউলিয়া দেশে বাস করছি।’

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে দেশটি বিদেশ থেকে বড়জোর তিন সপ্তাহের আমদানি খরচ মেটাতে পারবে। জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এখন আকাশচুম্বী। ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রল, ডিজেল কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন যা এক বছর আগে দেখতে পাওয়া শ্রীলঙ্কার চিত্রপটের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। গ্যাসের সিলিন্ডারের মূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় তারা এখন প্লাস্টিকের ব্যাগে গ্যাস ভরছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

পাকিস্তানের এক মন্ত্রী জনগণকে চা খাওয়া বন্ধ করার অনুরোধ করেছেন এই বলে যে, চা কিনতে যে ডলার প্রয়োজন পাকিস্তানে তা নেই। বিদ্যুৎ ব্যবহারে চলছে কঠিন নিয়ন্ত্রণ, এমনকি হাসপাতালগুলোতেও একই চিত্র। পাশাপাশি ওষুধের প্রাপ্যতা এবং মূল্য নাগালের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নিজেই বলেছেন এ পরিস্থিতি স্বপ্নের বাইরে। এমনকি ভ‚মিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্ক ভ্রমণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধকল্পে। 

এ যেন কিছু দিন আগের শ্রীলঙ্কার অবস্থারই পুনরাবৃত্তি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকাকে বলেছেন-পাকিস্তান অতীতে বিদেশ থেকে ঢালাওভাবে যে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধ করার কারণেই তাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছেছে। ডন পত্রিকাও জানিয়েছে আগামী এক বছরে দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে দেশটি দেউলিয়া তকমা এড়াতে পারবে না। আগামী সাড়ে তিন বছরে আট হাজার কোটি ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। যে সব দেশ থেকে নেওয়া ঋণ ভারে পাকিস্তান জর্জরিত, তার শীর্ষে রয়েছে চীন, ঠিক যেন শ্রীলঙ্কার প্রতিবিম্ব।

পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আশরাফ মাহমুদ খোলামেলাই বলেছেন, পাকিস্তান চীন থেকে এই প্রকল্পের জন্য কত ডলার ঋণ নিয়েছে তা তার জানা নেই। পাকিস্তানের গোটা বিদেশি ঋণের ৩০ শতাংশ নেওয়া হয়েছে চীন থেকে। চীন এই প্রকল্পের অধিক সুবিধাভোগী হওয়া সত্ত্বেও, সেই ঋণ শোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে।

পাকিস্তান ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন সময় সীমা নির্ধারণের অনুরোধ করলেও চীন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ চীনা ঋণের ফাঁদে পড়েই পাকিস্তানের এই দুর্দশা। শ্রীলঙ্কা, জিবুতি, কম্বোডিয়া, কেনিয়া এবং মালদ্বীপেও চীন একই কাণ্ড ঘটিয়েছে। 

চীনা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশ। কূটনীতির পরিভাষায় চীনের এ নীতিকে বলা হচ্ছে ‘ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে চীনের এ ঋণ ফাঁদ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। চীনা অর্থায়ন রয়েছে নেপাল ও মালদ্বীপেও। গরিব দেশগুলোকে চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে, এর কারণে দেশটির সমালোচনা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ-ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রহীতা দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে।

তবে চীন এসব অভিযোগ ‘প্রত্যাখ্যান’ করে বলছে, তাদের ‘ভাবমূর্তি’ বিনষ্ট করার জন্য পশ্চিমের কয়েকটি দেশ এ ধরনের বক্তব্য প্রচার করছে। এমন একটি দেশ নেই, যারা চীনের কাছ থেকে অর্থ ধার করার কারণে তথাকথিত ঋণের ফাঁদে পড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে-গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বেড়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। ঋণের পরিমাণ হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।

চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড খাতে’ শ্রীলঙ্কাকে দিতে হবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার জন্য সবচেয়ে সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো-এর বিশাল বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিষেবার বোঝা। বিশেষ করে চীনের কাছ থেকে ইতোমধ্যে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা। গত বছর তীব্র আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। যা কিস্তিতে পরিশোধ করছে দেশটি।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ নেপালেও দ্রুত কমতে শুরু করেছে বৈদেশিক রিজার্ভ। এ কারণে নেপালে অপ্রচলিত ও শৌখিন পণ্যের আমদানি সীমিত করা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সর্বশেষ সাত মাসে নেপালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৬ শতাংশের বেশি কমে ৯৫৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এই তথ্য নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের’। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই সময়ে নেপালে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। অন্যদিকে দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ৪৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

ঋণ নিতে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নেপালের অর্থনীতিবিদদের একাংশ। কারণ প্রকল্পগুলো নির্মাণে যে বিপুল ব্যয় হবে তা বহন করা হবে ঋণের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে সুদে-আসলে সেই ঋণ পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়ালে বিপাকে পড়বে নেপালই। চীনের সহায়তায় নেওয়া প্রকল্পের সুদের হার ২ শতাংশের মতো। ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান ঋণ পরিশোধে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেয়। চীনের ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে হয়, তাই কিস্তিও বেশি।

বাংলাদেশে ২০১২ সালে শাহজালাল সার কারখানা উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে চীনা ঋণের প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। এরপর ২০১৩ সালে পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প ও জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দুটি প্রকল্পই শেষ হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের বছরে মোট চারটি ঋণচুক্তি হয়। ২০১৭ সালে হয় আরও দুটি। এরপর প্রতিবছর একটি প্রকল্পের ঋণচুক্তির বেশি হয়নি।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। গত ১০ বছরে চীনের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। প্রকল্পগুলোর অন্যতম হলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ; শাহজালাল সার কারখানা; দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার; ইনফো সরকার-৩; ইত্যাদি। 

ইতোমধ্যে শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন। এই তিন প্রকল্পে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৯০ কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ হয়েছে। 

এই হিসাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সন্তোষজনক। চীন এই অঞ্চলের বড় উন্নয়ন সহায়তাকারী দেশ। কিন্তু ঋণদাতা চীনকে নিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতা যেহেতু সুবিধার নয় তাই বন্ধু এই ‘কালাপাখি’ থেকে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে নিজ স্বার্থ বিবেচনায় ধীরে বুঝে চলাই হবে শ্রেয়।

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //