গত ১২ এপ্রিল, বুধবার রাতে দীপ্ত টিভি চ্যানেলে ‘জয়তু মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ’ নামে একটি প্রতিবেদন দেখছিলাম। এই প্রতিবেদনটিতে ডা. জাফরুল্লাহ এবং তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম এ মুবিন তাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং ভারতের আগরতলায় ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ গড়ে তোলার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন।
সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কথা বিবেচনায় নেওয়া হলে মানতে হয় এই হাসপাতাল খালেদ মোশাররফ তৈরি করেছিলেন; ডা. জাফরুল্লাহসহ অন্যরা পরে এসে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস পাস করে ডা. জাফরুল্লাহ এফআরসিএস পড়ার জন্য লন্ডনে গমন করেন। একাত্তরে তার এফআরসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষার সাত দিন পূর্বে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আর পরীক্ষা দেবেন না, তার কাছে তখন ডিগ্রিধারী ডাক্তার হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করা। একাত্তরে লন্ডনের হাইড পার্কে বাঙালি প্রবাসীদের এক সমাবেশে তিনি তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। লন্ডনে এমন যুদ্ধের ময়দানে আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রথম শিশু সার্জন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামানও আমার ভাই মহিউদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। কাজী কামরুজ্জামানও চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণার্থে একই সময়ে লন্ডনে ছিলেন। আগরতলার ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ এবং গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, বিভিন্ন কারণে গণস্বাস্থ্য থেকে সরে এসে তিনি গরিবদের জন্য কমিউনিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে লন্ডনে প্রবাসীদের ভূমিকা, আগরতলায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য এবং ডা. জাফরুল্লাহকে নিয়ে মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতালে বিরতিহীন আলোচনা হয়েছে, আলোচক মহিউদ্দিন আহমদ এবং কাজী কামরুজ্জান, নীরব শ্রোতা ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদের স্ত্রী এবং আমি। পয়সা কম বলে আমরা সবাই কমিউনিটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতাম। তাদের আলোচনায় শোনা কথাগুলো নিয়ে কথা আজ কিছু বলব না, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরেকটি কলাম লেখার ইচ্ছে আছে।
আমার মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্যাডে মিডিয়ার জন্য যা লিখেছিলেন তা থেকেই তার মনের উদারতা ও পরার্থপরতার চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের নির্লোভ সাহসী কূটনৈতিক মহিউদ্দিন আহমদ। দুঃখে অভিমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এলেন না, আমরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না।’ শোক বাণীতে তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস চত্বরে এবং ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে মহিউদ্দিন আহমদের ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তার কথা অনুযায়ী মহিউদ্দিন আহমদ বিদেশস্থ প্রথম পাকিস্তানি কূটনীতিবিদ যিনি পাকিস্তানের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা অগ্রাহ্য করে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শক ও সহায়তাকারী হিসেবে।
ডা. জাফরুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণার্থে সিরিয়া হয়ে ডা. এম এ মুবিনসহ ভারতে পাড়ি জমান। পাকিস্তান সরকার সিরিয়ার বিমানবন্দরে তাদের পাকড়াও করার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। আগরতলায় গড়ে তোলা খড়ের ছাউনির হাসপাতালে শরণার্থী ছাড়াও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর থেকে বুলেট বের করে আনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল অপারেশন থিয়েটার। আগরতলার হাসপাতালটি স্বাধীনতা উত্তরকালে একই নামে সাভারে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রশাসন থেকে ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি ওঠে। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে ডা. জাফরুল্লাহ তিনটি এবং বঙ্গবন্ধু তিনটি নাম ঠিক করেন; পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর পছন্দে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি নির্বাচন করা হয়। ডা. জাফরুল্লাহর এক ডাক্তার বন্ধুর পরিবারের সম্পত্তি থেকে ৫ একর ভূমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য দান করা হয়। বঙ্গবন্ধুও ২৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে গণস্বাস্থ্যের জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সাভারে প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অভাবী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। ১৯৮১ সালে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, এখানে উৎপাদিত ওষুধের দাম অন্য যে কোনো কোম্পানির ওষুধের চেয়ে অনেক কম। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে। গরিব মানুষগুলো কম মূল্যে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতিদিন যত কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হয় তত ডায়ালাইসিস বাংলাদেশের সকল সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল মিলেও করে কিনা সন্দেহ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী। নারীদের ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানকার মেয়েরা কাঠমিস্ত্রি, ভারী যানবাহনের ড্রাইভার, প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধান করে নারী প্রহরী। সারা দেশে তিনি চষে বেড়িয়েছেন তার সার্বক্ষণিক নারী ড্রাইভার নিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই কিছুক্ষণ গণস্বাস্থ্যের মাঠে গিয়ে কৃষি কাজ করে থাকে।
বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে এরশাদ সাহেবের আমলে চালু হওয়া ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ওষুধ নীতির জন্য বাংলাদেশ আজ ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, এমনকি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারছে। প্রেস ক্লাবের এক সেমিনারে এই ওষুধ নীতির পক্ষে কথা বলায় আমার আরেক ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনির উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্ষেপে উঠেছিলেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ক্ষেপে ওঠার মুখ্য কারণ ছিল, ‘স্বৈরাচার’ এরশাদের কোনো গুণগান করা যাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। ওষুধ নীতি প্রণয়নের পূর্বে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ওষুধ উৎপাদন না করে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করত এবং অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুটে নিত। ওষুধ নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে ২ হাজার ৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। এই নীতি প্রণয়নের পরপর অসংখ্য দেশি ওষুধ কোম্পানি গড়ে ওঠে।
ঢিলেঢালা শার্ট-প্যান্টে তাকে একজন নির্মোহ মানুষ মনে হতো। আটপৌরে পোশাক-পরিচ্ছদ তাকে স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব দিয়েছিল, তিনি মহাত্মা গান্ধীর মতো নিজের পোশাকের ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। একজন মানুষ যখন তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যান তখন তার অন্য কোনো বাহ্যিক অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ধূমপানমুক্ত এলাকা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে ধূমপান পরিত্যাগ করে বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিল। সাধারণ জনগণের স্বার্থে তিনি সব সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলে স্বাধীনভাবে কাজ করার ব্ল্যাংক চেক দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান; ডা. জাফরুল্লাহ উত্তরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, যারা ব্ল্যাংক চেক দেয় তাদের ব্যাংকে টাকা থাকে না।
রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি জাত রাজনীতিবিদদের মতো কথাবার্তায় কূটনীতির কৌশল অবলম্বন করতেন না, যা মনে আসত তাই বলে দিতেন-কে রাগ করল, কে খুশি হলো তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। রাজনীতির মাঠে তিনি অনেক অসংলগ্ন কথাও বলেছেন; মাঝেমধ্যেই জনসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে যুক্ত হয়ে সংবাদ শিরোনাম হতেন। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি চান না, কাদের মোল্লা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন-এমন কথা বলায় ছাত্র ইউনিয়ন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
উল্লেখ্য, ডা. জাফরুল্লাহও ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সেনাপ্রধানকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক এবং ভুল তথ্য দিয়ে পরে ডা. জাফরুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড টেস্টিং কিটের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মিডিয়ায় এসে জাফরুল্লাহ চৌধুরী জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, তার এমন কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে আমি দৈনিক সংবাদে একটি কলাম লিখেছিলাম।
ডা. জাফরুল্লাহ চেয়েছিলেন রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতা হোক। চীনপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল বিএনপির সঙ্গে। সেমিনার কর্মশালা, সভা-সমাবেশে তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করতেন এবং বিভিন্ন সঙ্কটে বিএনপিকে নানা বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তার বক্তব্য বিএনপির বিরুদ্ধে গেলেই দলের নেতারা তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতেন। ডা. জাফরুল্লাহ যখন বলেন, ‘বিএনপি এখন লন্ডন থেকে আসা ওহিতে চলছে’ তখন ছাত্রদল নেতা কাউসার গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কে যে বিএনপিকে আপনার কথায় চলতে হবে?’ কাউসারদের এমন গর্জনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মৌন সমর্থন থাকত। তাই বোধ হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানাতে সময় লেগেছে বিএনপির।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চিরতরে চলে গেলেন ১১ এপ্রিল রাত ১১টায়। করোনা রোগের আক্রমণে তার লিভারের ক্ষতি হয়েছিল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় মৃত্যুর আগে ওষুধ কাজ করছিল না। মারা গেলেন কিডনি রোগে, বহু বছর ধরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে বেঁচে ছিলেন। কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তার বন্ধুদের পয়সায় আমেরিকায় গিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি তিনি।
গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন, কিন্তু নিজের জন্য এক টুকরো সম্পত্তিও করেননি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিজমা দান করে গেছেন বোনকে। মরণোত্তর দেহদান করায় দাফনের জন্যও তার কোনো জমির প্রয়োজন ছিল না; কিন্তু অজুহাত সৃষ্টি হওয়ায় কবরের জমি শেষ পর্যন্ত লাগল।
অসাম্প্রদায়িক ডা. জাফরুল্লাহ প্রমাণ করে গেছেন সৎ, নির্লোভ ও নির্ভীক হওয়ার জন্য ধার্মিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার ছাড়াও তিনি অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন; কিন্তু যে পুরস্কারটি তাকে অমর করে রাখবে তা হলো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। বাঙালি জাতি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh