নাটকের মান ও পেশা নিয়ে সোচ্চার হতে হবে

৭০/৮০-এর দশকে টেলিভিশন নাটকের গল্প ছিল বাঙালির রুচি নির্মাণের। শুধু টেলিভিশনের নাটক নয়, বাংলা চলচ্চিত্রেও ছিল পারিবারিক আবহে বাংলার মানুষের দিনযাপনের গল্প। পোশাক, সংলাপ, কাহিনি সবকিছুর মধ্যে একটা আদর্শিক বিষয়, মার্জিত, শালীনতা ছিল। নব্বই দশক পর্যন্তও এই ধারাটা অব্যাহত ছিল। এমনকি একবিংশ শতকের শুরুতেও আমরা অনেক ভালো নাটক পেয়েছি।

কিন্তু শেষ এক দশকে নাটকে একটা অস্থিরতা চলছে। কাহিনি, সংলাপ এমনকি পোশাকেও আমরা বাংলাদেশকে পাচ্ছি না। আগে নাটক সিনেমা দেখে দর্শক নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করত। আমাদের সেই নিজস্বতা আজ যেন হারাতে বসেছি। একসময় তারকাদের স্টাইল দর্শকদের ফ্যাশন হয়ে উঠত। এখন সেই ঢেউ নেই বললেই চলে। সেই তারকাও আমরা পাচ্ছি না অনেক দিন।

স্টাইল এবং ফ্যাশনের কথা যখন এলোই তখন মূল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি স্টাইল এবং ফ্যাশন নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। স্টাইল এবং ফ্যাশন কিন্তু এক জিনিস নয়। দুটো সম্পূর্ণভাবে আলাদা বিষয়। স্টাইল হলো নিজস্ব আর ফ্যাশন হলো সামষ্টিক। চিত্রনায়ক মিঠুন চক্রবর্তী ব্লেজারের সঙ্গে যখন টাই না পরে মাফলার পরতেন এটা ছিল তার সৃষ্ট নিজস্ব স্টাইল।

যখন ওই স্টাইলটা অনেকেই ফলো করল তখন ফলোয়ারদের কাছে সেটা হয়ে গেল ফ্যাশন। একইভাবে নায়ক সালমান শাহ মাথায় রুমাল বা স্কার্ফ বাঁধতেন। তার আগে বাংলাদেশের কোনো নায়ককে ওভাবে দেখা যায়নি। সেটা ছিল সালমান শাহর নিজস্ব স্টাইল। সেই স্টাইলটা যখন তার ভক্তরা ব্যবহার শুরু করল তখন সেটা হয়ে গেল ফ্যাশন।

আমরা যারা দর্জিকে জামাকাপড় বানাতে দেই তখন সেটা হয় একান্তই আমাদের জন্য, নিজস্ব। কিন্তু যখন রেডিমেড জামাকাপড় কিনি তখন সেটা আমাদের নিজস্ব নয়। সেটা বানানো হয় আমাদের মতো কারও জন্য, সেখান থেকে আমরা পছন্দ করে কিনি। এখানে নিজস্বতা নেই, আছে ফ্যাশন। 

একইভাবে রুচি হলো নিজস্ব বিষয়, অনেকটা ব্যক্তিত্বের মতো। সেই ব্যক্তিত্ব গঠনে অনুপ্রাণিত করত আমাদের সেই সোনালি অতীতের টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকগুলো। কিন্তু ইদানীং আমরা সেই নিজস্বতা হারাতে বসেছি, যা মঙ্গল নয়।

কিছু কিছু ভালো কাজ যে হচ্ছে না তা অবশ্য নয়। কিন্তু টেলিভিশন নাটকের মান এখন নিম্নমুখী এ কথা অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। এখানে নাটকের নাম, গল্প, সংলাপ, অভিনয় সবই সৃষ্টিছাড়া। নাটক একই গল্পের ফ্রেমে আটকে আছে, যে গল্প অসামাজিক। আমাদের গ্রামজীবন এক স্নিগ্ধ ঐতিহ্যিক আবহে ছিল। সেই গ্রামের নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে ভাঁড়ামো করা হচ্ছে। পোশাক, সংলাপ, অভিনয় সবই আরোপিত।

অশ্লীলতার চরম সীমানায় পৌঁছেছে। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছে। নাটকে দেখা যায় একই গ্রামের মানুষ বিভিন্ন স্বরে একটি ভাষায় কথা বলছে, যা হচ্ছে না। ধরা যাক নাটকে দেখানো হচ্ছে গ্রামটা বরিশালের। সেহেতু গ্রামের সবাই বরিশালের ভাষায় কথা বলবে। কিন্ত সবাই তো ভাষাটা পারে না। কারণ শিল্পীরা বাস্তব জীবনে সবাই তো বরিশালের মানুষ নয়। ভাষাটা দাঁড়াচ্ছে না। সে কারণে কেউ পাবনার টোনে, কেউ ময়মনসিংহের টোনে, কেউ নোয়াখালীর টোনে বরিশালের ভাষা বলছে। এসব নিয়ে অনেকেই বিব্রত।

টেলিভিশনের দর্শকও দিন দিন কমছে। শিল্পী কলাকুশলীদের পেশাগত বৈষম্যও চোখে পড়ার মতো। কোনো শিল্পী দিনে লাখ টাকা পেমেন্ট নিয়ে যাচ্ছে ভাঁড়ামো করে, কেউ আবার দুই হাজার টাকাও পাচ্ছে না ঠিকমতো। চরিত্রাভিনেতাদের তো দেখাই যাচ্ছে না তেমন করে। গল্প হচ্ছে ২/৩টি চরিত্র নিয়ে। বাবা, মা, ভাই. বোন এসব আলঙ্কারিক চরিত্রগুলো অনুপস্থিত। ফলে নাটকের ঐ ২/৩টি চরিত্রকে এতিম মনে হয়।

এসব নিয়ে কথা বলা দরকার, কারণ এটা শিল্পের জায়গা। শিল্পে সততা থাকতে হবে। গত বিশ/পঁচিশ বছরে যে সমস্ত শিল্পী তথাকথিত স্টার খেতাব পেয়েছে তাদের ৯৫% ভাঁড়ামো করে স্টার হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা ছিল মৌলিক ধারার নান্দনিক কাজে। তাদেরকে সে পথে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

কুরুচিপূর্ণ মস্তিষ্ক বিকৃত গল্প নিয়ে যারা নাটক বানাচ্ছেন, পেশাগতভাবে ঠকাচ্ছেন প্রকৃত শিল্পীদের, তাদের বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে মুরব্বি নাট্যজনদের। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে যে তরুণরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তারাই সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিয়েছেন তখন। তাদের অনেকেই এখনো আছেন এই শিল্পের অভিভাবক হয়ে। শিল্পের প্রতিটি মানুষ যেন ভালো থাকে সে উদ্যোগ কেবল আপনারাই নিতে পারেন। একটি দেশের সমৃদ্ধি কতখানি হয়েছে তা পরিমাপের মাপকাঠি হলো সেই দেশের সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ।

সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে, তথ্য মন্ত্রণালয় আছে আপনাদের কথা শোনার জন্য। কথা বলুন সংস্কৃতির সামষ্টিক সমস্যা নিয়ে। একটি সুস্থ সুন্দর জাতি গঠনে আপনাদের প্রজন্মের অনেকেই এখনো আছেন। আমরাও আছি। নতুন প্রজন্মও আছে। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে কথা বলুন টেলিভিশনের সঙ্গে, এজেন্সির সঙ্গে। সিন্ডিকেট ভাঙুন। শিল্পের আবার সিন্ডিকেট কিসের? সম্মিলিত উদ্যোগে একটা প্রশান্তিময় পরিবেশ তৈরি করতে হবে শিল্পের আঙিনায়। এই দায়িত্ব আপনাদের মতো মুরব্বিদের, আপনাদের মতো অভিভাবকদের। আমরাও সঙ্গে থাকব অন্য সকল সময়ের মতো। 

কবি, অভিনেতা 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //