সামনে নির্বাচন : বিবেকের ভূমিকায় সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি

একটানা দুই মেয়াদে ১০ বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন শেষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিদায় নিলেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর বিদায়ের পর স্বপদে তার কাজ নিয়ে নানা দিক থেকে মূল্যায়ন হয়। সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাজেরও মূল্যায়ন হচ্ছে এবং হবে। তবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য ছিলেন। 

দেশের ২০ ও ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ রেকর্ড সময়কাল ওই পদে ছিলেন। সংবিধান অনুযায়ী এর চেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রপতি থাকা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৪ মার্চ ২০১৩ তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০১৩ থেকে ২০২৩-এই সময়কালে রাজনীতিতে টানাপড়েন ও ঝড়ঝাপটা খুব একটা কম হয়নি। কিন্তু তিনি অবিতর্কিত থেকে গেছেন। 

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে কলেজে থাকাকালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়ার পর থেকে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্র-জনতার মধ্যে ছিলেন। সংগ্রামে-আন্দোলনে পোড় খেয়ে তিনি এমন এক রাজনৈতিক আর্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাকে বিতর্কিত করা যেত না।

মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, সবচেয়ে কম বয়স ছিল তার। ৭ বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পর্যায়ক্রমে ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় উপনেতা, স্পিকার, রাষ্ট্রপতি প্রভৃতি পদে বরিত হন। প্রতিটি পদেই তিনি অবিতর্কিত থেকে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

তার কথাবার্তা, বক্তৃতা, চলাফেরা, আচরণ প্রভৃতি সবকিছুতেই এক সরলতা। তেমন  বিজ্ঞ পণ্ডিত মনে হয় না, আবার জ্ঞানের আকরের সন্ধানও যেন মেলে। কেন যেন মনে হয় বই পাঠে যা পাওয়া যায়, তার চাইতে বেশিই আয়ত্ত করা যায় জনগণের জীবন থেকে পাঠ নিলে। মনে হয় নিখাদ মাটি, গণমানুষের মধ্য থেকে তিনি উঠে এসেছেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে অভিভাবক হিসেবে যেমন তিনি, তেমনি জনতারও একজন। আবহমান বাংলা বিশেষত ভাটি অঞ্চলের মানুষের রাজনীতি-সংস্কৃতির যথার্থ প্রতিনিধি তিনি।

এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণেই বিদায়ক্ষণে তিনি এমন ভাষণ ও সাক্ষাৎকার দিতে পেরেছেন, যা দেশের রাজনীতির জন্য দিকনির্দেশ হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদের ৫০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশনে তিনি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন, যা ছিল সংসদে তার শেষ বক্তৃতা। দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ৩ দিন পর ২৬ এপ্রিল তার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার ‘সমকাল’ দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ক্ষমতায় থাকতে একরকম আর ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অন্য রকম এমনটা তিনি নন। বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে একই ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে।

দুটোতেই তিনি গণতন্ত্র বিকশিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে না পারার সংকটের স্বীকৃতিই কেবল দেন নাই, বাস্তব বিবেচনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য তরুণ সহযোদ্ধা এবং বর্তমানের অভিভাবক হিসেবে সংকট সমাধানের পথরেখাও বাতলে দিয়েছেন। জাতির বিবেকের ভূমিকা তিনি নিয়েছেন। তবে এটা তো ঠিক, রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিবেকের ভূমিকা প্রায়শই গ্রাহ্য হয় না। নির্বাচন সামনে রেখে আসছে সময়গুলোতে তার বক্তব্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়, তা কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক কেন, ত্রিকালদর্শী ভবিষ্যৎবক্তাও বোধকরি বলতে পারবেন না। 

উল্লেখিত বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছেন, তা স্বব্যাখ্যাত। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি পদ আনুষ্ঠানিক। বিশেষভাবে সংসদে কোনো বক্তৃতা দিতে হলে তা ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। গণতন্ত্রের সংকট সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা পড়ে-শুনে অনেকের কাছ থেকেই এমন মন্তব্য এসেছে এবং আমারও মনে হয়েছে, এই বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি স্বাধীনভাবে। তার অভিজ্ঞতালব্ধ চিন্তা ও মতের বহিঃপ্রকাশ এই বক্তৃতা।

এমন একটি দিকনির্দেশমূলক বক্তৃতা, যাতে সাধারণভাবে সরকারি দলেরও সমালোচনা রয়েছে, তা দেওয়ায় সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। বিএনপি আমলে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কথা দেশবাসীর স্মরণে রয়েছে। রাষ্ট্রপতির পদই তাকে কেবল ছাড়তে হয়নি, রেল লাইন দিয়ে দৌড়াতে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জমিরউদ্দিন সরকারকে গণভবনে গিয়ে বসে থাকতে হতো প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। বক্তৃতাটি দিতে দেওয়ায় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগও নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রমনা দেশবাসীর ধন্যবাদ পাবে।    

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও গণতন্ত্র যে সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়ে উত্তরণের জন্য সংসদের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন : এক. গণতন্ত্রহীন অবস্থায় উন্নয়ন সর্বজনীন হতে পারে না। উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। দুই. ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। তিন. গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। চার. সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে সবার সহায়তা করা উচিত। পাঁচ. সরকার ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার ফলে দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে রয়েছে। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘সংকট তো আছেই’ মন্তব্য করে সংকটের সমাধানকল্পে তিনি আরও অগ্রসর হয়ে বলেছেন, এক. ক্ষমতায় যেতেই হবে- এই মানসিকতা বর্জন করা জরুরি। দুই. সংলাপেই সংকটের সমাধান, সবাইকে ছাড় দিতে হবে। তিন. রাজনীতি নিয়ে পরদেশ-নির্ভরতা দেউলিয়াপনা। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। চার. তৃণমূলে রাজনীতি করেন, তাদের এগিয়ে আনতে হবে। সচিব ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা অবসরে গিয়েই এমপি হওয়ার বাসনা এবং ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী সংসদ দখল করার বিষয়টি গভীর শঙ্কার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তিনি বলেন, তারাই যদি এমপি হন, তাহলে যারা মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি করেন, তারা পাবেনটা কী?

এসব বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বলেছেন, ‘সংকট তো আছেই। কেউ নির্বাচনে আসতে পারে, আবার কেউ কেউ নির্বাচনে নাও আসতে পারে। ষড়যন্ত্রও হতে পারে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দিলে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তা হলে বুঝতে হবে তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। আবার সরকার যদি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে, তাহলে বুঝতে হবে তাদেরও অন্য উদ্দেশ্য আছে। এমন উদ্দেশ্য কারোরই থাকা উচিত নয়।’

সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতির কথাগুলো বিবেচনায় নিলে এটা সুস্পষ্ট হবে যে, যেভাবে তিনি সংকটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে দুই দলকে সমালোচনা করে সমাধানের পথ সম্পর্কে বলেছেন, তা বলার মতো মর্যাদাশীল বিবেকবান মানুষ এখন নেই বললেই চলে। এই দিকটা বিবেচনায় নিয়েই একান্ত সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছেন, মধ্যস্থতার আহ্বান জানালে তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কি না? ‘সে ধরনের প্রস্তাব এখনো আসেনি’-এমন মন্তব্য করে এর উত্তর সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। এটাই স্বাভাবিক।

অতীতে পারস্পরিক আলোচনা, মধ্যস্থতা, গোলটেবিল, চিঠি আদানপ্রদান কোনোটাই রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টির কাজে লাগেনি। বাস্তবে ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, দেখা-অদেখা যেসব ফ্যাক্টর ক্রিয়াশীল, সেসবের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়েই রাজনীতির গতিপথ নির্ধারিত হয়। ঘাত-প্রতিঘাতের ভারসাম্যমূলক অবস্থানে যে দল বা শক্তি অবস্থান নিতে পারে, তারাই বিজয়ী হয়। অভিজ্ঞতা বলে, এই ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে শেষ বিচারে জনগণই হয় ঘটনার মূল নিয়ন্ত্রক। তাই আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ যেমন চাইবে বৃহত্তর গণসমাবেশ তার পক্ষে সমবেত করতে, তেমনি বিএনপিও তা চাইবে।

ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী লীগের জন্য তা সহজ, বিএনপির জন্য কঠিন এমনটা অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বলা যায় না। কঠিনের জয় করেই তো ক্ষমতায় বসতে বা থাকতে হয়। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। তবে বিএনপির রয়েছে বাইরের-ভেতরের বাধাবিঘ্ন। সবচেয়ে বড় সমস্যা দলের মাথা আদালতের রায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত। একজন শাস্তি ভোগ করছেন। অপরজন পলাতক ও নিন্দিত। 

আওয়ামী লীগেরও রয়েছে বাধাবিঘ্ন, এর মধ্যে বড় হচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট। দুই দলেই রয়েছে সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতির কথামতো ‘নীতি-আদর্শহীন’ ‘হতে চান’, ‘ভাগ চান’ এমন ধরনের নেতা। তবে কোনো দলই একঘরে নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন দল ও শক্তির মেরুকরণ রয়েছে দুই দলেরই। এই অবস্থায় যে দল যত বেশি করে গণসমাবেশ শক্তি নিজপক্ষে আনতে পারবে, সেদলের পক্ষেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, দেখা-অদেখা ফ্যাক্টরগুলো ব্যতিক্রম বাদে অংশ নিতে থাকবে।

অতীতের মতো ক্ষমতার ভারসাম্য নিজ পক্ষে আনতে জনসম্পৃক্তির কৌশল বাদ দিয়ে বিএনপি যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমদানি করে কিংবা নির্বাচন বয়কট লাইন অব্যাহত রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি না নিতে থাকে, তবে দলটি নিজ পায়ে আবারও কুড়াল মারবে। উল্টোদিকে ভারসাম্য যদি আওয়ামী লীগ টিকিয়ে না রাখতে পারে, তবেও দলটি বিপদে পড়বে। এই বিবেচনায় নির্বাচনপূর্ব বর্তমান দিনগুলোর গুরুত্ব দুই দলের কাছেই অপরিসীম। শেষ সময়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বিবেচনায় নিয়ে যে দল সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ‘ছাড় দিতে হবে’ উপদেশ না শুনবে, সেদলই পড়বে সর্বনাশের ফাঁদে।


লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //