ফেরদৌসী রহমান: একটি ফ্যান-নামা ও সেকালের মধ্যবিত্ত চিত্রায়ণ

সকালে উঠতে কোনোদিন ভালো লাগেনি আমার, আজও না। কদিন আগে কাজের কারণে সকাল সাতটায় মানে আমার কাছে ভোরে উঠতে হয় এক অনুষ্ঠানে যেতে। প্রাপ্তি না থাকলে রাজি হতাম কিনা জানি না। ছোটবেলায় স্কুল শুরু হতো আটটায় মানে সাতটায় ঘর ছাড়া। কী অমানবিক! অথচ সেই আমি, যার বয়স তখন দশও হয়নি, কোনো কোনো বিশেষ দিন উঠতাম ভোরে। তারপর রেডিওর সামনে অপেক্ষা করতাম। কারণ ফেরদৌসী রহমানের গান। মা বলতেন, ‘আসল ভক্ত।’ আমি ১৯৬০-৬১ সালের কথা বলছি।

দুই

রেডিওর প্রোগ্রামের সময়সূচি বই পাওয়া যেত। বোধ হয় নাম ছিল ‘বেতার জগৎ’। সেটা দেখে কখন ওনার গান হবে সেটা জেনে রাখতাম, মিস যেত না। নজরুল গীতি, রাগপ্রধান বাংলা গান আর ভাওয়াইয়া। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাহাইয়া রে...’ গানটা আজও মুখস্থ। বহু গান আজ অন্যের কণ্ঠে শুনলে কানে বাজে ফেরদৌসীর গলা। আমি তো ফ্যান বটেই কিন্তু আমার কাছে তিনি কেবল শিল্পী ছিলেন না, সেই সময়ের যে সংস্কৃতির বলয়ের মধ্যবিত্ত, তারও চিত্র ছিলেন ও আছেন। তিনি কেবল নন, তার প্রজন্মও সবল ছিল। সেটা কেন হয়েছিল?

তিন

আমরা গায়ক আব্বাসউদ্দীনকে জনমানসে জায়গা দেই নাই। যদিও প্রকৃত পূর্ববঙ্গ/বাংলাদেশে আদি গায়ক কেউ যদি হন সেটা তিনি। বাবা-মার কাছে শুনেছি তার সামাজিক ভূমিকা। যারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল ১৯৪০ থেকে ৪৭, তাদের কাছে তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। কিন্তু বাংলাদেশের সুশীলরা অনেকেই ‘পূর্ববঙ্গ’ বিরোধী, তারা হলেন ‘এপার বাংলা ওপর বাংলা’ করতে চান। যদিও ওপার বাংলা এক সাথে থাকতে চায়নি যখন প্রস্তাব আসে, ১৯৪৭ সালে। ভোট দিয়ে বাংলা ভাগ করে।

চার

যেখানে কলকাতার বাবু কালচার ওপরে, সেখানে আব্বাসউদ্দীনের হাইল্লা কালচারের স্থান নাই। তাই তাকে ভুলে যাওয়া জায়েজ। ফেরদৌসী তার কন্যা, এই ভুলে যাওয়া কিংবদন্তির সিলসিলা বহনকারী। তাই কাউকেই মনে রাখার দরকার নাই। আমাদের ভুলে যাওয়ার কারণ আমাদের বর্তমান মধ্যবিত্তের অবস্থান ও ইতিহাস। যাদের নিজেদের কোনো শক্তি নাই বা ধার করা অনেকটাই, সরকার তার ছায়া না দিলে টিকতে কষ্ট হয় তাদেরই নির্ভরশীলতার মানসিকতা অনেক বেশি। তারা স্বস্তি পায় কলকাতার গায়কদের গান শুনে, আব্বাসউদ্দীনের নয়। স্বদেশ খোঁজে কিছুতে হলেও অন্য দেশের ইতিহাসে।

পাঁচ 

বাড়িতে গান চর্চা ৫০-৬০ দশকের ঢাকার মধ্যবিত্তের রেওয়াজ ছিল। আর একটা কারণ হতে পারে তারা ছিল মূলত আধুনিক-নাগরিক। তাদের আচার ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত ছিল কিছুটা স্বনির্ভরতায়ই, এর সূত্র কিন্তু ছিল কলকাতা। তারা বেড়ে ওঠে শহরে। বর্তমান মধ্যবিত্তের একটু গ্রাম ভিত্তি বেশি, তাই একটু কনফিডেন্স কম, তাই ছোটে কলকাতায়। কে কী বলল তার ওপরে জীবন চলে সেটা মক্কা হোক অথবা কলকাতা। এই জন্য সবাই ফেসবুকে, সবাইকে জানানো হচ্ছে সে কে যাতে সবাই কিছু বলতে পারে তাকে নিয়ে। সেই কালে আমাদের বাড়ি বা অন্য আমাদের মতো মানুষের ভাবনায় গান শেখা আর ধর্ম চর্চার কোনো সংঘর্ষ ছিল না। আমার মা অনেকের মতোই নামাজি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু; বোরকা/হিজাব পরার প্রশ্ন আসে না। এমনকি নামাজ পড়তেন এবং উস্তাদের কাছে গিটার শিখতেন। বেশি দিন শেখেননি কিন্তু এই চর্চা ছিল অনেক ঘরেই। আমরা গান শিখতাম, রেডিও থেকে নিজে প্রথম গান তুলি। রাগ প্রধান দিয়ে শুরু, আজ মনে আছে গানগুলি। যেমন মনে আছে ফেরদৌসী রহমানের গান।

ফেরদৌসী রহমান।

ছয় 

কিন্তু আমার ভক্তি আরও বেশি উনার প্রতি কারণ তিনি ভালো ছাত্রী ছিলেন। তিনি ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেন, ইউনিভার্সিটিতে সম্ভবত পঞ্চম স্থান নিয়ে পাস করেন সমাজতত্ত্বে। মানে এর চেয়ে বহু বাজে ছাত্র-ছাত্রী প্রফেসর পÐিত হয়েছেন পরে, যা উনি চাইলেই হতে পারতেন। কিন্তু তার সংগীতের অর্জন এত বিরাট যে আমরা ভুলে গেছি তার বিদ্যার কথা। কিন্তু তার পরিবারের চেহারা থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়। উনার ভাই প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, এক ভাই শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী, উনার স্ত্রী আসমা আব্বাসী ও অন্যরা। পরের প্রজন্মে রয়েছে নাশিদ কামাল, তার মেয়ে আরমেন মুসা। এই সব নাম মনে করিয়ে দেয় যে সমাজের ওপর তলা নির্মিত হচ্ছিল বিভিন্ন শ্রেণি ও চর্চা দিয়ে। ১৯৭১-এর পর এটা পাল্টায় নয়া রাষ্ট্র হওয়ার ফলে। এখন কেবল টাকাওয়ালাদের দাপট। মধ্যবিত্ত এত দুর্বল, তাকিয়ে থাকে পরের দিকে। 

সাত

নজরুল বা ভাওয়াইয়া ফেরদৌসী রহমানের চেনা ব্র্যান্ড। কিন্তু উনি যে তার কালের প্রধান আধুনিক গানের শিল্পী এটা আমাদের মনে আছে। এত গান যে হিসাব দেওয়া যাবে না। আমার পাঁচটা প্রিয় গানের নাম বলি।

১. বলাকা মন হারায়ে যায় আকাশের ওই সুদূর সীমায়

২. ও... কৃষ্ণচূড়া রূপের আগুন ছড়িয়ে দিল

৩. লোকে বলে প্রেম, আমি বলি জ্বালা

৪. কার ছায়া পড়েছে, মনের আয়নাতে

৫. কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু 

আর পাঁচটা দিলে একটা ফ্রি : আমি সাগরের নীল...

এ ছাড়া তো আছে কয়েকটা উর্দু গান যার মধ্যে ‘এ আরজু জাওয়ান জাওয়ান...’ আমার খুব প্রিয়।

ভালো লাগা গানের তালিকার শেষ নাই।

আট

যে মধ্যবিত্ত ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সামনে ছিল, সেটার চেহারা ছিল ভিন্ন। কারণ তার ইতিহাস ছিল আলাদা। তারা আলাদা রাষ্ট্র পেতে পেতে প্রথম পর্যায়ে ব্যর্থ হয়। এই জন্য তাদের ভেতর ক্ষোভটা কাজ করেছিল অনেক বেশি। এতে বিবাদের বিষয়টা যেমন ছিল, তেমন ছিল উৎকর্ষ সাধনের তাগাদা। এই ম্যাট্রিক্সটা ১৯৭১-এর পর পাল্টে যায়, যাওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ আসে নয়া আকাক্সক্ষা ও সুযোগ। রাষ্ট্র অর্জন অনেক দুরূহ কাজ রাষ্ট্র গঠনের মতোই, কিন্তু তার গ্রামার আলাদা। নয়া মাধ্যম তো বটেই। খ্যাতি ও প্রচারের সুযোগ বেশি, স্থিরতা ও স্বস্তি একটু কম। তখনকার সেলিব্রিটিদের নিয়ে স্ক্যান্ডাল কম, এখন অনেক, এবং এটাই স্বাভাবিক বিষয়। লাইফস্টাইলের কারণে শুধু নয়, মিডিয়ার চোখ এখন বিস্তৃত। মধ্যবিত্ত আছে কিন্তু অনেক বিচ্ছিন্ন, অনেক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, দেখা হয় কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার সাগরে। ফেরদৌসী রহমানের চিত্র কেবল নিজের নয়, সময়ের বটে। 

নয়

যে গানটা সাতটায় শুনছিলাম, মনে পড়ল ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম/লুটাইয়া কাঁদে তব পায়ে প্রিয়তম... 

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //