বাংলাদেশ ও রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু

যেহেতু আমি ৫ বছর ধরে রাশিয়ায় শিক্ষকতা করছি, দেশে আসার পর প্রায়শই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, বাংলাদেশ এবং রাশিয়ান স্কুল এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী? 

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে আলোচনাটি খুবই জটিল হয়ে ওঠে। কারণ এটা বলা যায় না যে একটি সিস্টেম সামগ্রিকভাবে অন্যটির চেয়ে ভালো, তবে আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু আপাত দার্শনিক পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করতে পারি। বাংলাদেশের সিস্টেম একটি ট্র্যাডিশনাল শিক্ষাব্যবস্থা, যাকে আমি কয়েকটি প্রধান পার্থক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করব। এ ছাড়াও শিক্ষা ব্যবস্থার মান এবং সামগ্রিক স্কুলিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে দুটি দেশের তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে।

আমি সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ব্রিটিশ স্কুলে পড়াই, যেখানে মূলত ইংল্যান্ডের জাতীয় পাঠ্যক্রম এবং রাশিয়ান জাতীয় পাঠ্যক্রম উভয়ই অনুসরণ করে। আমাদের স্কুলে-মর্নিং এবং ডে দুটি শিফট আছে। সকালের শিফটে ইংরেজি এবং দিনের শিফটে রাশিয়ান মাধ্যম। আমি সকালের শিফটে পড়াই। যেহেতু স্কুলটি দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ান মাধ্যম শুরু করে, যার ফলে রাশিয়ান মাধ্যম সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পেয়েছি। কারণ পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষক উভয়ই একাডেমিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে একসাথে যুক্ত।

রাশিয়া এবং বাংলাদেশের স্কুলিং সিস্টেমের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও কাঠামো, পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং শিক্ষাগত ফলাফলের দিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পার্থক্য রয়েছে। অমিলগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত তহবিল, বিশ্ববাজারে কারিকুলামটির গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষকদের প্রতি সম্মানের ধরন, শিক্ষা বা শিক্ষকের মান, পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষক বেতন, পাঠ্যক্রম, জাতীয় শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব ও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। 

রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা এখন ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের পথে। রাশিয়ায় যদিও কিছু বেসরকারি স্কুল রয়েছে তবু সবচেয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোপরি একমুখী বলা যায়। বিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয়। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের সব অঞ্চলে শিক্ষা ও বিদ্যালয় একই মানের। যদিও জিমনেশিয়ামগুলো কিছুটা উচ্চ মানের হয়ে থাকে, তবু গুণগত দিক থেকে বিশাল পার্থক্য দেখ যায় না। বলা বাহুল্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা উল্টো।

কিছু মিল

কিছু বিষয় বাংলাদেশ এবং রাশিয়া উভয় ক্ষেত্রেই একই। উভয় দেশেই শিক্ষার্থীরা যে প্রাথমিক বিষয়গুলো অধ্যয়ন করে, যেমন-সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি অনেকটা একই রকম। আমাদের দেশের মতোই তরুণ ছাত্ররা তাদের সামাজিক জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেমন সবচেয়ে বড় পপ গায়ককে, এবং বাংলাদেশের মতোই তারা তাদের প্রিয় ক্রীড়া দলগুলোকে অনুসরণ করে। রাশিয়ার জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রম অনুসারে শিক্ষকরা সম্ভাব্য সর্বোত্তম নির্দেশনা, ছাত্রদের জীবন মান পূরণ এবং তাদের কাছে থাকা সময়ের মধ্যে সব পাঠ সম্পন্ন করে দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ চাকরির বাইরে টিউটরিং করে জীবিকা নির্বাহ করার চর্চা বা প্রয়োজন নেই সেখানে।  

স্কুলের গঠন

রাশিয়ায় স্কুলিং তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত প্রাথমিক (গ্রেড ১-৪), প্রাথমিক মাধ্যমিক (গ্রেড ৫-৯), এবং উচ্চ মাধ্যমিক (গ্রেড ১০-১১)। প্রাথমিক এবং প্রাথমিক মাধ্যমিক পর্যায় বাধ্যতামূলক, উচ্চ মাধ্যমিক ঐচ্ছিক। 

বাংলাদেশে স্কুলিং দুটি পর্যায়ে বিভক্ত,  প্রাথমিক (গ্রেড ১-৫) এবং মাধ্যমিক (গ্রেড ৬-১০)। বাংলাদেশের মতোই প্রাথমিক শিক্ষা ছয় বা সাত বছর বয়সে শুরু হয় এবং চার বছর স্থায়ী হয়। এর পর রয়েছে পাঁচ বছরের মাধ্যমিক এবং দুই থেকে তিন বছরের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা। শিক্ষার্থীরা কলেজে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বেছে নিতে পারে বা সেই সময়ের জন্য স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে। 

স্কুলের সংগঠন

বাংলাদেশের শিক্ষার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, মাধ্যম ও পাঠ্যক্রম। সমাজে শ্রেণি বিভাজন স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট হয় যখন একটি বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সকল শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করার জন্য কাজ না করে মানুষকে বৈষম্যে বিভক্ত করে। এই ব্যবস্থায় যাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক পুঁজি নেই তারা বঞ্চিত হতে থাকে।

সাধারণত বাংলাদেশের স্কুলগুলো প্রাথমিক, মধ্য/জুনিয়র উচ্চ এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে সংগঠিত হয়। প্রাইভেটসহ স্কুলে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এবং পরীক্ষা খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়। 

স্কুলের পর শিক্ষার্থীরা কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের অধীনে পড়া শিখতে হয়। স্কুলে সাধারণত পড়া দেওয়া-নেওয়া এবং বাসায় মূলত পড়া শিখতে হয়। রাশিয়ায় স্কুলগুলো সাধারণত ১ থেকে ১১ গ্রেডে সংগঠিত হয়। সমস্ত গ্রেড একটি বিল্ডিংয়ে থাকে। কিন্ডারগার্টেন (প্রায়) ২ বছর থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য। কিন্ডারগার্টেনের আগে, শিশুদের জন্য ‘ক্রেচ’ আছে-আমাদের ডে-কেয়ারের মতো।

রাশিয়াতেও পরীক্ষা হয়, তবে পরীক্ষার ধরন বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সহনশীল। যা-ই হোক, রাশিয়ায় যদিও শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে পড়া শেখার জন্য বাড়িতে কোনো গৃহশিক্ষক বা প্রশিক্ষকের কাছে যেতে হবে না। সাধারণত স্কুল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে থাকে।

রাশিয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে। এটি উচ্চতর, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং বয়স্কসহ নাগরিকদের বিভিন্ন শিক্ষার সুযোগ প্রদানের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। গবেষণা এবং উদ্ভাবনের উপর জোর দেয় এবং একটি দক্ষ ও জ্ঞানী কর্মশক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করে।

কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে সকল নাগরিককে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের উপর গুরুত্ব দেয়। সিস্টেমটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার অ্যাক্সেস প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। 

প্রি-স্কুল

রাশিয়ায় প্রি-স্কুল শিক্ষা তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে শিশুদের জন্য প্রদান করা হয়। এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে একে অত্যন্ত উৎসাহিত করা হয়। রাশিয়ায় প্রি-স্কুল শিক্ষা শিশুদের সামাজিক, মানসিক এবং শারীরিক বিকাশকে উন্নীত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। সেখানে প্রি-স্কুল শিক্ষা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে পাবলিক কিন্ডারগার্টেন, প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন এবং পারিবারিকভাবে পরিচালিত ডে-কেয়ার। রাশিয়ার প্রি-স্কুলের কর্মীদের মধ্যে সাধারণত প্রশিক্ষিত শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত থাকে যারা একটি ব্যাপক শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রদানের জন্য একসঙ্গে কাজ করে। প্রি-স্কুলের শিক্ষকরা ছোট বাচ্চাদের শেখাকে আকর্ষক এবং মজাদার করার জন্য গেম, গল্প বলা এবং গ্রুপ ক্রিয়াকলাপসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশি সরকারি স্কুলিং সিস্টেমে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সীদের জন্য কোনো প্রি-স্কুল নেই। কেবল বেসরকারি স্কুলগুলোতে একটি নির্দিষ্ট আয়ের গোষ্ঠীর জন্য এই ব্যবস্থা রয়েছে। এটি সাধারণত ব্যয়বহুল। 

পাঠ্যক্রম

রাশিয়ায় পাঠ্যক্রমটি ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক অধ্যয়ন, শারীরিক শিক্ষা এবং শিল্পকলার উপর গুরুত্বসহ একটি বিস্তৃত-ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দেয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ এবং কর্মজীবনের লক্ষ্যগুলোর উপর ভিত্তি করে বিশেষ পাঠ্যক্রম বেছে নিতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক অধ্যয়ন এবং বৃত্তিমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা স্কুলে পড়ার পর্যায়ে নির্ভর করে। 

পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম

রাশিয়ায় একাডেমিক এবং পাঠ্যক্রম বহিভর্‚ত বিষয় যেমন সঙ্গীত, নৃত্য, শিল্প, যন্ত্রসংক্রান্ত শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বিষয়গুলো কেবল ঐচ্ছিক, যা সব স্কুলে দেখা যায় না। রাশিয়ান পদ্ধতিতে তাদের শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা, যেখানে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বাংলার প্রকৃত সংস্কৃতিকে জানে না। তাছাড়া সারা পৃথিবীই হয়তো জানে যে রাশিয়া টেকনোলজি, আর্ট, কালচারে বিখ্যাত। রাশিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রিটিক্যাল থিংকিং ডেভেলপমেন্টের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়, অন্যদিকে বাংলাদেশে এখনো এই কসেপ্টটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।

খেলাধুলা, খাবার এবং ব্যায়াম

রাশিয়ান স্কুলগুলোতে খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার উপর বিস্তর জোর দেওয়া হয়। ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ বেশিরভাগ দেশে স্থূলতা একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়লেও রাশিয়াই ইউরেশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে স্থূলতার হার অনেকাংশে কম এবং তাদের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস স্কুল কর্তৃপক্ষের সতর্ক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়। ফলস্বরূপ বেশিরভাগ রাশিয়ান শারীরিকভাবে বেশ ফিট। তাই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভালো করতে পারে। 

মানসিক শিক্ষা

রাশিয়ান স্কুলগুলো শিশুদের শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার যত্ন নেয়। তাই কর্তৃপক্ষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার যত্ন নেওয়ার জন্য মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগ করে। যেখানে বাংলাদেশি শিক্ষকরা শিক্ষক স্বায়ত্তশাসন এবং ঐতিহ্যগত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করছেন, সেখানে রাশিয়ায় শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical thinking) এবং সমস্যা সমাধান দক্ষতার (problem solving skill) ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষাদান পদ্ধতি

রাশিয়ায় শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনামূলক কৌশল ব্যবহার করেন, যার মধ্যে রয়েছে দলগত কাজ, প্রকল্প এবং অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা। বাংলাদেশে শিক্ষাদান পদ্ধতিটি আরও ঐতিহ্যবাহী এবং এটি মুখস্থ করার উপর নির্ভর করে। শিক্ষকরা তথ্য জানাতে বক্তৃতা এবং অনুশীলন ব্যবহার করেন। রাশিয়ায় বিদ্যালয়ের প্রশাসক অধ্যক্ষ এবং সহকারী অধ্যক্ষ এখনো অন্তত একটি কোর্স পড়ান! বাংলাদেশের স্কুলে প্রিন্সিপাল এবং সহকারী প্রিন্সিপালরা সাধারণত ক্লাস নেন না। 

শিক্ষাগত মান

রাশিয়া এবং বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের মান। রাশিয়ার শ্রেণিকক্ষগুলো সুসজ্জিত এবং প্রযুক্তি সমর্থিত। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল কৌশল ব্যবহার করেন-যেখানে পাঠ সমর্থিত প্রপ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারিকভাবে শেখানো হয়, যাকে বলা হয় কার্যকলাপ-ভিত্তিক শিক্ষা এবং তাদের প্রায়ই পাঠ-সম্পর্কিত শিক্ষা সফর থাকে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন তেমন হয় না এবং মান নিশ্চিত হয় না। 

মুখস্থ বনাম সৃজনশীল সমস্যা সমাধান

রাশিয়াতে শিক্ষার্থীদের শুধু সমস্যা সমাধান নয়, এর পিছনে ‘কেন’ বোঝার ওপর ফোকাস করা হয়। উদাহরণস্বরূপ গণিত শেখার সময় শিক্ষার্থী শুধু টাইম টেবিল শেখে না, তারা গুণনের ক্রিয়াকে শারীরিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য ম্যানিপুলটিভ কৌশল ব্যবহার করে। তারা শেখে কীভাবে বিভিন্ন উপায়ে গুণ করতে হয়: সবগুলোই বোঝার লক্ষ্যে গুণন যেভাবে কাজ করে। বাংলাদেশে অবশ্য কখনো কখনো সঠিক উত্তর পাওয়া এবং মুখস্থ করার ওপর অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। যা-ই হোক একজন শিক্ষক হিসেবে আমি এখনো প্রশ্ন রাখছি যে আজ কতটা প্রাসঙ্গিক সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।

পাঠদানে শিক্ষকদের স্বাধীনতা

আমাদের দেশের শ্রেণিকক্ষে কী এবং কীভাবে শেখাবে সে বিষয়ে শিক্ষকরা স্বায়ত্তশাসিত নয়। রাশিয়ার সমস্ত সরকারি ব্যবস্থা একটি কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়, তবু বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক ক্ষমতাশালী। এটি রাশিয়ান নাগরিকদের কাছে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যা পুরো বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ফলে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য রাশিয়ায় পাড়ি জমায়।

শিক্ষাগত ফলাফল

রাশিয়ার সাক্ষরতার হার উচ্চতর এবং বাংলাদেশের তুলনায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় নথিভুক্ত ছাত্রদের সংখ্যাও বেশি। এছাড়া রাশিয়ার শিক্ষাগত ফলাফলগুলো অঞ্চল এবং শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে, শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তি একটি প্রধান সমস্যা, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের মেয়ে এবং শিশুদের জন্য। শিক্ষার মানও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, অনেক বিদ্যালয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদের অভাব রয়েছে।

স্কুল সময়নিরূপণ তালিকা

বর্ধিত স্কুল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে স্কুলের দিনগুলো রাশিয়ার তুলনায় ছোট, বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা করে হয়।

আফটার স্কুল ক্লাব

রাশিয়ান স্কুলগুলো অনেক বেশি সংগঠিত। বাচ্চাদের বড় বড় ব্যাজের ভারে নুয়ে চলতে হয় না। তাদের স্কুল-পরবর্তী অনেক ক্লাব রয়েছে যেখানে তারা পাঠের বাইরে খেলতে এবং আনন্দ করতে পারে।

চূড়ান্ত উত্তর

আমি চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিশ্লেষণ করতে। কোন শিক্ষাব্যবস্থা ভালো বা খারাপ তা বিচার করতে পারা আসলে কঠিন। আমার মনে হয়, যদি আমরা উভয় সিস্টেমের শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে পারি, একে অপরের থেকে শিখতে পারি এবং একটি সিস্টেমের কার্যকারিতা গ্রহণ করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবে। 

একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে একটি বাস্তবসম্মত, সবার জন্য উন্মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যা রাশিয়া তার সমস্ত ছাত্রদের জন্য প্রদান করেছে এবং আজ একটি অদম্য জাতিতে রূপান্তর হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হবে যদি বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের শিক্ষা প্রয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা হলো একজন শিক্ষার্থীর জীবনের শিক্ষার প্রথম পর্যায় যেখান থেকে তারা নিজেকে গড়ে তুলতে শেখে এবং সেই শিক্ষার মান নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার অগ্রগতিতে আর কোনো বাধা থাকতে পারে না।

শিক্ষক, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //