মওলানা ভাসানীর শেষ সংগ্রাম ফারাক্কা লংমার্চ

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আমৃত্যু উৎপীড়নবিরোধী সংগ্রামের মহানায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর। দুর্বিনীত শাসকের ত্রাস। সেই উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত অবিভক্ত ভারত, পূর্বপাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে তিনি জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে গর্জে উঠেছেন। তাঁর এক ডাকে পঙ্গপালের মতো লাখ লাখ মানুষ ঘর ও কাজ ছেড়ে বাইরে চলে এসেছে।

তাইতো আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁকে নিয়ে  লিখেছেন- ‘আমাদের মিলিত সংগ্রাম, মৌলানা ভাসানীর নাম’। আর কবি শামসুর রহমান তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’তে ভাষণরত মওলানার আন্দোলিত হাতকে ‘বল্লমের মত ঝলসে ওঠে বারবার’ বলে বর্ণনা করেছেন। পশ্চিমী দুনিয়ার গণমাধ্যম তাঁকে ‘ফায়ার ইটার’, ‘রেড মওলানা অফ দ্য ইস্ট’ ইত্যাদি বিশেষণে চিত্রিত করেছে আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম মানুষের সংগ্রামে নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে। টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে, দিয়েছে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ উপাধি। 

তিনি স্টকহোমে আফ্রো-এশীয় শান্তি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের সাথে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন যুদ্ধবাদিতার বিরুদ্ধে।

মজলুমের পক্ষে অবস্থান নেওয়া মওলানা ভাসানীর জীবনের সর্বশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা ফারাক্কা লংমার্চ। ১৯৭৬ সালের মে মাসে ফারাক্কা লংমার্চের মাধ্যমে যে দাবি জানানো হয়, তার ন্যায্যতা আজও সমানভাবে বিদ্যমান। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার প্রয়োজনে ভারত সরকার আান্তর্জাতিক নদী গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর পূর্বে এমনকি পাকিস্তান আমল থেকেই যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু হয়নি, তখন থেকে এই সম্পর্কে আলোচনা ও প্রতিবাদ উঠেছে। ৭৪ থেকেই ভাসানী ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদ করে আসছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে তিনি বারবার তাগিদ দিয়েছিলেন যে, এ সমস্যার সমাধান না হলে দুদেশের মধ্যে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে না। 

এর পর অনেকদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল তিনি আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেন, ‘যদি ভারত সরকার বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানি না দেয় তা হলে ১৬ মে  রাজশাহী থেকে লক্ষ জনতার শান্তিমিছিল ফারাক্কার অভিমুখে যাত্রা শুরু করবে। তিনি বলেন, ভারতের সরকার কিছু না করুক; আমরা ষাট কোটি জনতার কাছে বিচার চাইব।’ 

এর আগে তাঁর সাথে একাধিক পত্রবিনিময় হয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের ওপর ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেন এবং সেখানে তিনি তাঁর লংমার্চ কর্মসূচির বিষয়েও অবহিত করেন।

ইন্দিরা গান্ধী পত্রের জবাবে লেখেন- ‘এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি বর্তমানে আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।’

এ চিঠির জবাবে মওলানা ভাসানী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখেন- ‘আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার ওপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপূরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে আমার এরূপ প্রত্যাশা ছিল না। ফারাক্কা সম্পর্কে আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি- বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সফর করে আমাদের কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা নিরূপণ করার জন্য। আমি আপনাকে সরকারি কর্মকর্তাদের রিপোর্টের ওপর আস্থা স্থাপন না করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সমস্যার স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।’

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের আগে মওলানা ভাসানী জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ড. কুট ওয়ার্ল্ডহেইম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ড, গণচীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কুসিগিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা প্রেরণ করে ভারতের ওপর তাদের চাপ প্রয়োগ করে গঙ্গার পানির সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প মূলত ছিল ভীষণ রকম প্রাণবিনাশী, যার কারণে বাংলাদেশ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও তার প্রভাব পড়ছিল।

তবে দেনদরবারে খুব একটা সুরাহা না হওয়ায় রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ শুরু করেন মওলানা ভাসানী। লংমার্চ শেষ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে। লাখো লাখো প্রতিবাদী মানুষের স্রোতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজশাহীর পথ-প্রান্তর।

কানসাটের ঐতিহাসিক জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির ওপর তোমাদের তেমনই অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শাশ্বত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও। গঙ্গার পানিতে আমাদের ন্যায্য অধিকার, এটা আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার, এ অধিকার পশু, পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ সব কিছুর জন্মগত অধিকার। এ অধিকার হরণ করার ক্ষমতা কারও নেই। বাংলাদেশের প্রাণবান মানুষ কোনো দিন তা মেনে নেবে না।’ 

এরপর তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে বলেন, “আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের বাঁচার পথ করে দেবেন”।

এই লংমার্চ শুধু দেশ না আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপকভাবে সাড়া তৈরি করেছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চের মাধ্যমে  মওলানা ভাসানী শুধু এদেশের নন এশিয়ার অন্যতম ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //