আমাদের কোনটি প্রয়োজন খাদ্য না তামাক?

আজ ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘We need food: not tobacco’ বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’। তামাকের উৎপাদন ও ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। এই বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সচেতন ও সোচ্চার হলেও এটি যে পরিবেশের জন্য কতোটা হুমকি সেটা আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতিবছর তামাক চাষের জন্য প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি ধ্বংস হয়। তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনের জন্য বছরে ২ লাখ হেক্টর বন উজাড় হয় এবং মাটিতে ক্ষয় সৃষ্টি করে। তামাক উৎপাদন পানি, জীবাশ্ম জ্বালানী ক্ষয় করে। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেটের বাট যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থাকে। ফলাফলে ১.৬৯ বিলিয়ন পাউন্ড বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি করে এবং হাজার হাজার রাসায়নিক বায়ু, পানি ও মাটিতে নিঃসরণ হয়।

প্রতি বছর ৮৪ মেগাটন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান গ্রিন হাউস গ্যাসের সাথে সাথে তামাক উৎপাদন ও ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। জলবায়ুর স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস করে, সম্পদ নষ্ট করে এবং একইসাথে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে।

তামাক উৎপাদন ও ব্যবহারে পরিবেশের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে সেটি ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহটির স্থায়িত্বকাল ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। পরিবেশের উপর এই নেতিবাচক প্রভাব চূড়ান্তভাবে মানব স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাচ্ছে তাই নয়, এটা পৃথিবীতে বাস করা সকল প্রাণীকুলকে ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসাবে ভূমিকা রাখছে।

তামাক চাষে যে ধরণের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলি এতোটা বিষাক্ত যে সরাসরি মানব দেহে প্রবেশ করে ক্ষতি করছে; একই সাথে বাতাসে মিশে পুরো জীববৈচিত্র্যকেই অসুস্থ করে তুলে। যার জন্য এটা সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয়ে একটা বড় ধরনের নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

সাধারণভাবে যে কীটনাশকগুলি ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে ইমিডাক্লোপ্রিড, ক্লোরপাইরিফস, ডাইক্লোরোপ্রোপেন, অ্যালডিকার্ব, মিথাইল ব্রোমাইড। এগুলি প্রত্যেকটি মানবদেহের ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫ মিলিয়ন কীটনাশক বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কর্মী কীটনাশকজনিত বিষক্রিয়াতে মৃত্যু বরণ করে!

তামাকের পরিবেশের উপর এমন নেতিবাচক প্রভাবকে আড়াল করার জন্য তামাক কোম্পানিগুলো  ‘গ্রীনওয়াস’ নামে বিশ্বব্যাপী একটি কার্যক্রম পরিচালনা করে। সিএসআর এর নামে তারা বৃক্ষরোপণ, সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি বিতরণ এ ধরনের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসমস্ত কাজে তারা একটি বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু যেটি তারা ক্ষতি করে তার তুলনায় এটি কিছুই না। বস্তুত পরিবেশকে বিপর্যস্ত করা এবং মানুষের মৃত্যু কোনটির ক্ষতিই টাকা দিয়ে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তামাক যেভাবে পরিবেশকে দূষিত করছে এটার জন্য পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের সরকারকেও বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ধারণা করা হয় বিশ্বব্যাপী এই ব্যয়ের পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার!

বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি জাতের তামাক চাষ হচ্ছে। এগুলো হলো- ভার্জিনিয়া, মতিহারি ও জাতি। বিবিএস এর কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০২০ এর তথ্যানুসারে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জাতি চাষ হয়েছে ১৯ হাজার ৮৬০.৭৫ একর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৮২০.৬৭ মেট্রিক টন। মতিহারি চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৮০৬ একর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৯৭৪.০৩ মেট্রিক টন। ভার্জিনিয়া চাষ হয়েছে ৭০ হাজার ৩৩৯.২০ একর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ৬৫ হাজার ৫৮.০৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট ১ লাখ ৬০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।

বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এটা ভয়াবহ তথ্য। তামাকের এই চাষ পরিবেশের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। এটা শুধুমাত্র জমির হিসাব। এর সাথে যুক্ত হবে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ সময়ের ক্ষতি, ব্যবহারকালীন ক্ষতি এবং সর্বশেষ বর্জ্য থেকে। একদিকে পরিবেশ আর অন্যদিকে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে সরাসরি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলাফল দুই মিলিয়ে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি। কোন ফসল ও দ্রব্যের দ্বারা এতো বহুমুখী ক্ষতি সাধিত হয় না যা তামাকের মাধ্যমে ঘটে।

যে সময়ে এই বিশাল আকারের জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে সেই সময়ে এই জমিতে খাদ্য শস্য উৎপাদন হতে পারতো। তামাক চাষ করা হয় রবি ফসলের মৌসুমে। সেকারণে এই সময়ে তামাক চাষের পরিবর্তে নানা ধরণের সবজি, ডাল, ধান উৎপাদন হতে পারতো। কিন্তু সেটি না হয়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলা একটি ক্ষতিকারক কৃষিপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যার জন্য মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে। পরিবেশকে বিনষ্ট করে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। পরিতাপের বিষয়, কৃষি পরিসংখ্যান এটাকে নেশা জাতীয় ফসলের আওতায় রাখলেও এর অর্থনৈতিক বিবেচনায় একে অর্থকরী ফসল বলা হচ্ছে। 

তামাক উৎপাদনকালীন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহারকালীন এবং সর্বশেষ বর্জ্য পর্যন্ত সব পর্যায়ে যেমন জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে একইরকমভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে। ফেলে দেওয়া সিগারেটের বাট বা গোড়া যেকোনো উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য বাঁধার কারণ হচ্ছে। 

এ্যাংগলিয়া রাস্কিন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ন্যূনতম ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট বাট পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, যা উদ্ভিদের জন্য সবচেয়ে বড় আকারের প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি করছে। বেশিরভাগ সিগারেটের গোড়া বা বাটে থাকে একটি সেলুলোজ এসিসেট ফাইবারের তৈরি ফিল্টার, যা একধরণের বায়োপ্লাস্টিক।

জীব বিজ্ঞানী ড. ড্যানিয়েল গ্রিন বলেন, ‘আমরা দেখছি যে, সিগারেটের এই অবশিষ্টাংশ উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগমের সফলতা এবং চারা গাছের কাণ্ডের দৈর্ঘ্যরে ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ঘাস এবং গুল্মের কাণ্ডের ওজন অর্ধেক হ্রাস করে দেয়’।

সিগারেটের বাট মানুষের জন্য যতোটা বিষাক্ত একইরকমভাবে অন্য প্রাণীদের জন্য এটা সমধিক বিষাক্ত। এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, পানি-ভিত্তিক প্রাণীকে খুব সহজেই বিষাক্ত করে ফেলে। এর ফলাফলে সমুদ্র সৈকতের তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসী, বড় বড় জলজ প্রাণী যেমন- বড় কচ্ছপ, সীল, হাঙ্গর এমন সকল জলজ প্রাণীর জীবন সংশয়পূর্ণ হয়ে উঠছে। এছাড়াও বনে বসবাসকারী প্রাণীর উপরেও তামাক এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বন উজাড় করার অর্থ হচ্ছে প্রাকৃতিক বাসস্থানের ক্ষতি করা। ফলশ্রুতিতে অনেক প্রজাতির প্রাণী ক্রমশই নেই হয়ে যাচ্ছে। তামাকের কারণেই এটি ঘটছে। 

ধূমপান আবাসিক অগ্নিকাণ্ডের একটি অন্যতম কারণ এবং এটি সাধারণত ঘটে থাকে অসবাধানতাবসত ফিল্টারের অবশিষ্টাংশ যেখানে-সেখানে ফেলার জন্য। প্রতিবছর এজন্য হাজার হাজার বাড়ি এপার্টমেন্ট, মার্কেট পুড়ে যায়। ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। 

এছাড়াও দাবানলের জন্যও ধূমপান ব্যাপকভাবে দায়ী। ধোঁয়া সম্পর্কিত দাবানল অকারণে আবাসস্থল ধ্বংস করে এবং মানুষের জীবন-জীবিকা নষ্ট করে। নিভে যাওয়া সিগারেটের বাটও প্রচণ্ড বিপদজনক। কারণ সেগুলি যে প্লাস্টিকের উপাদান দিয়ে তৈরি তা অত্যন্ত দাহ্য এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আগুন ধরতে পারে।

এই সর্বনাশা পথ থেকে সরে আসার এখনই সময়। আমাদেরকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে, তার জন্য পরিবেশকে রক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয় কাজ। তামাক পৃথিবীর একমাত্র ফসল যার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না। তামাক যারা সরাসরি গ্রহণ করছে তাদের যেমন ক্ষতি, যারা গ্রহণ করছে না তাদেরও ক্ষতি, সর্বোপরি আমাদের শিশুরা ভয়ঙ্করভাবে এই ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে।

তামাক চাষ বন্ধ করা এবং উৎপাদিত তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই। এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া এসডিজি’র ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ১১, ১৩, ১৪, ১৫ এর  কোনটিরই পূর্ণাঙ্গ অর্জন সম্ভব হবে না।

কারণ উল্লেখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তামাক সরাসরি বাধা সৃষ্টি করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে, ‘২০৪০ সালের পূর্বে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়তে হলে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি। তারমধ্যে অন্যতম তামাক চাষকে সর্ব পর্যায়ে নিরুৎসাহিত করা, তামাক কোম্পানি থেকে অনতিবিলম্বে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করতে হবে। তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দিষ্ট করারোপ করা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি দক্ষিণ এশীয় স্পিকারদের শীর্ষ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা তামাকের উপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিব। এর উদ্দেশ্য হবে দেশে তামাকজাত পণ্যের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং একইসাথে এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি করা’।

পরিতাপের বিষয়, অদ্যাবধি এই বিষয়টি নিয়ে সরকার এখনো কোন কার্যক্রম শুরু করেনি। প্রতিবছর জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিকালীন সময় থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলো এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা উত্থাপন করলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোন ধরণের ভূমিকা গ্রহণ করছে না। চলতি বছরেও তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দিষ্ট করকাঠামো প্রস্তাবনা আকারে উত্থাপন করা হয়েছে। আমরা আশা করবো আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখতে পাবো।

লেখক: আবু নাসের অনীক, উন্নয়ন কর্মী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //