বিশ্ব পরিবেশ দিবস: আমাদের বাস্তবতা

“The world is too much with us; late and soon, /Getting and spending, we lay waste our powers; —/ Little we see in Nature that is ours;/ We have given our hearts away, a sordid boon!” কবি Wordsworth এর পক্তিমালা বিশ্ব পরিবেশ দিবসে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে আমরা এক মরণ খেলায় মেতে উঠেছি। আমাদের পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এই বিপর্যয় প্রাণী বসবাসের একমাত্র উপযোগী ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহটির অস্তিত্বকেই হুমকীর সম্মুখীন করছে। 

গত বছর ১৮ মে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পল্যুশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষাক্ত বায়ু ও বর্জ্যের দূষণের কারণে দেশে প্রতি বছর ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত এ মৃত্যুতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। শুধুমাত্র বায়ু দূষণে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। 

এই বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতির একটি অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ না হওয়া-বৃক্ষ কেটে ফেলা। কিন্তু আমরা বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হই। একটি দেশে বনভূমি থাকা প্রয়োজন ২৫%। বাংলাদেশে আছে খাতা-কলমে ১৭%, বাস্তবে যার অস্তিত্ব কোনভাবেই ৭-৮% এর বেশি নয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘তপোবন’ প্রবন্ধে বলছেন, “মানুষকে বেষ্টন করে এই যে জগৎপ্রকৃতি আছে, এ যে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মানুষের সকল চিন্তা সকল কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি কোনো মতে প্রবেশাধিকার না পায় তাহলে আমাদের চিন্তা ও কর্ম ক্রমশ কলুষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতল-স্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে মরে।” পরিবেশ প্রকৃতিকে না বাঁচিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। তার মর্মবাণী আজ খুব বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 

এই ধরণীকে রক্ষায় বৃক্ষরোপণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ করলেই আর না কাটলেই পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ বৃক্ষের যে কাজ তার জন্য তো তাকে পরিবেশ দিতে হবে। সেই পরিবেশ এখানে নিশ্চিত হচ্ছে না। বায়ু দূষণের মাধ্যমে বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনচক্র রক্ষা পাচ্ছে না। 

সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ক্লোরিন ইত্যাদি বায়ু দূষক উপাদান বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সালফার অক্সাইড, হাইড্রোজেন ফ্লুরাইডের প্রভাবে বৃক্ষের স্বাভাবিক সালোকসংশ্লেষন বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে অক্সিজেন কমে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীর সকল প্রাণীকূলের উপর পড়ে। এই সমস্ত বায়ু দূষক বৃক্ষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ সকল বিষয়কে বাধাগ্রস্ত করে। উদ্ভিদের আয়ু কমিয়ে দেয়।

ডব্লিউএইচওর বায়ুমান নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বাতাসে ক্ষুদ্র ভাসমান কণা পিএম ২.৫ এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হলেই ওই বাতাসকে আর স্বাস্থ্যকর বলা যায় না। এমন বস্তুকণার ঘনত্বের তারতম্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বাতাসে পিএম ২.৫ এর গড় ঘনত্বের পরিমাণ ছিল ৭৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। এটি সমীক্ষার ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই হিসেবে বিশ্বে গতবছর বাংলাদেশের বাতাসই ছিল সবচেয়ে দূষিত।

বায়ু দূষণের কারণগুলি কী? এর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, রাস্তাঘাট ও বাড়ি নির্মাণের সময় সৃষ্ট ধুলোবালি, যানবহনের দূষণ। এই সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের এখন যে সমস্ত অসুখ হচ্ছে এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে শ্বাসনালীর অসুখ বেশি দেখা যাচ্ছে। যা সৃষ্টির প্রধান কারণ বায়ু দূষণ। 

আজকে দেশে পরিবেশের যে বিপর্যয় এর অন্যতম আরও একটি কারণ শব্দ দূষণ। যখনই শব্দ ক্ষতিকর এবং বিরক্তিকর হয় তখনই সেটা হয় শব্দ দূষণ। আমরা ২০ ডেসিবেল থেকে ১২০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ শুনতে পাই। ২০ ডেসিবেল নিচে এবং ১২০ ডেসিবেল উপরে আমরা শব্দ শুনতে পাই না। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রা ৬০-৭০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ। অর্থাৎ ৭৫ ডেসিবেলের উচ্চমাত্রার শব্দই শব্দ দূষণ। এখানে আমাদের চারপাশে হরহামেশাই ৭৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ হচ্ছে। 

এই শব্দ দূষণ শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে না, অন্য সকল পশু-পাখি-গাছ-পালা সবার জন্য ক্ষতি করছে। শব্দ দূষণের কারণে এখন গাছগুলিতে পাখি আর তেমনভাবে বসে না। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। আধুনিকতা আর উন্নয়নের নামে যে যথেচ্ছার চলছে এটা বন্ধ করা প্রয়োজন। যানবাহনের অতিরিক্ত হর্ণের ব্যববহার, কলকারখানার উচ্চ শব্দ, উচ্চ শব্দযুক্ত গান বাজনা, বিশেষকরে আবাসিক এলাকায় বন্ধ করা আবশ্যক। 

এসব ছাড়াও পানি দূষণ, নদ-নদী সংরক্ষণ করতে না পারা, মাটির দূষণ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ছে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়ে বেড়াচ্ছি! কিন্তু এর জন্য আমাদের কতেটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এর মূল্যায়ন করছি না।

দেশ আজ তীব্র তাপদাহে আক্রান্ত। বিগত ৫৮ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার সম্মুখীন দেশবাসী। একে তো বাতাসে নেই আদ্রতা, তার ওপরে এ ক’দিন তাপমাত্রা ছিল স্থানভেদে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তীব্র তাপদাহের কারণ সম্পর্কে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রথমত, যেসব এলাকায় দিনে বেশি গরম এবং রাতে তাপমাত্রা কমছে, সেসব এলাকায় জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বায়ুদূষণের কারণে স্থানীয় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক আবহাওয়ার নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, যা বঙ্গোপসাগর থেকে আসা মেঘমালা সৃষ্টি এবং বৃষ্টিপাতের ধরনকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০২১), জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৮), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন (২০১৭), পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০১৬), পরিবেশ আদালত আইন (২০১০), শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা (২০০৬) এধরনের এতোসকল আইন-বিধি আর নীতিমালার পরেও পরিবেশ বিপর্যয় কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, শাসকগোষ্ঠী যখন আইনের তোয়াক্কা করে না   তখন সাধারণকে সেই আইন মানানো কোনভাবেই সম্ভব হয় না।

পরিবেশ সমীক্ষাকে পাশ কাটিয়ে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ মেগা প্রজেক্টগুলি করা হচ্ছে। কীভাবে বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে? এখানকার ‘বিপর্যয়’কে অনেকটাই আমরা আমন্ত্রণ করে আনছি!  

চেঞ্জ ইনিসিয়েটিভের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতায় বাংলাদেশে প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এই দূষণে প্রতি পরিবারের বছরে গড়ে চিকিৎসাবাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের একটি অন্যতম কারণ এই পরিবেশ দূষণ।

আমাদেরকে সামগ্রীকভাবে ভাবতে হবে। উন্নয়ন আমরা করবো, করতে চাই; কিন্তু উন্নয়নের মাধ্যমে অর্জন আর বিষর্জনের তুলনামূলক আলোচনায় নজর দিতে হবে। গত ২৫ বছরে ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি নেই হয়ে গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে! ঢাকার এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা কমেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় সীসা দূষণের স্বীকার ৬ লাখ মানুষ। ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের শরীরে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটেছে। 

শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে এক দুষ্টুচক্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই চক্র থেকে বেরিয়ে না আসলে আমরা আমাদের জীবন, আগামী প্রজন্ম কাউকেই রক্ষা করতে পারবো না পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে। আমাদেরকে প্রশ্ন তুলতে হবে এই দূর্বৃত্তায়িত ভূমিকার বিরুদ্ধে। একটি সুস্থ পরিবেশ পাওয়া আমার সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার যখন সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না তখন পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্দোলনের বিকল্প কিছু থাকে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //