সংলাপ সংঘাত এবং নির্বাচন

সংঘাতের আশঙ্কা, নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা, সংলাপ নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। জনমনে আশঙ্কা, নির্বাচন কি হবে? যদি হয় তা হলে তা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবে তো? যদিও টাকা, পেশি শক্তি, প্রচার মাধ্যম, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাজে লাগানো, আঞ্চলিকতা নিয়ে আবেগের ব্যবহার নির্বাচনের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নষ্ট করে। তারপরও জনগণের সরল প্রত্যাশা, একটা আপাত সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তর্ক-বিতর্ক হোক, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে পারুক এবং প্রত্যাশা পূরণ না হলে প্রতিবাদ করার পরিবেশ থাকুক। কিন্তু এই সরল চাওয়াটাও কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। 

নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি আলোচনায় আসে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেমন হবে। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশা সবসময় ছিল এবং আছে। নির্বাচন কমিশনের যতটুকু ক্ষমতা আছে সেটা প্রয়োগে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ সবসময় ছিল। কিন্তু যখন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয় তখন আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়। নির্বাচন নিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে সেখানে হস্তক্ষেপ করা এবং প্রয়োজনে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল নির্বাচন কমিশনের। উনিশশ বাহাত্তর সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৭ম অধ্যায়ের ৯১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি-প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে, নির্বাচন কমিশন যে কোনো ভোট কেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতে সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ সকল নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার সংকোচনের কেন প্রয়োজন পড়ল তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ এবং বিতর্ক। 

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিগত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের প্রতিটি নিয়ে কমবেশি বিতর্ক আছে। কিন্তু ৪টি নির্বাচন আপাত সুষ্ঠু হয়েছে বলে মনে করা হয়। যেগুলো হলো, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে এসব নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি। সে কারণেই এই দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য তদারকি সরকার দরকার। 

কিন্তু কী হবে সেই সরকারের রূপরেখা? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একসময় উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। আন্দোলনে দাবি আদায়ও হয়েছিল। কিন্তু যে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা ছিল; তারাই এখন প্রবল বিরোধী। ফলে নির্বাচনের চাইতে নির্বাচনকালীন সরকারের গ্রহণযোগ্যতাই এখন বিতর্কের প্রধান ইস্যু। 

যে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হলে সংঘাত বাড়ানো নাকি আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা হবে এই প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহল। চূড়ান্ত সংঘাতে একটা এসপার ওসপার কিছু হয়ে যাক অথবা আলাপ আলোচনা করে কিছু ধরে কিছু ছেড়ে একটা আপাত সমাধান করা এই দুই পক্ষে মতামত আসতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সংঘাত সহিংসতা এড়িয়ে আপাত সমাধানের জন্য সংলাপের বিকল্প নেই বলে একটা প্রবল জনমত আছে। সংলাপ তো একা একা হয় না। বিবদমান পক্ষগুলোর অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। তখন প্রয়োজন হয় সেখানে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারীর। এটা নিয়েও চলছে কথার লড়াই।  

ক্ষমতাসীন জোট ১৪ দলের সমাবেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বলে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তব্য দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধি আসুক আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই, কীভাবে সবাই মিলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। সেটা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা হতে পারে, অন্য কোনো পথে নয়। তার এই বক্তব্য আলোচনার টেবিলে ঝড় তোলে। নানা প্রশ্ন, সন্দেহ দেখা দিল এই বক্তব্যে। সংকট নিরসনে সরকার কি নতুন কোনো পথ উন্মোচন করল? নাকি বাজারে কথা ছেড়ে দিলেন যাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই চিন্তা কি নেতার ব্যক্তিগত না দলীয় সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নানা কথা ডালপালা মেলতে শুরু করল।  

ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকরা ছুটতে থাকেন দায়িত্বশীল অন্যান্য নেতার মন্তব্য জানার জন্য। দেখা গেল এই বক্তব্যের পরদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আলোচনার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তিনি আরও বলেন, আমাদের সমস্যা আমরা নিজেদের আলোচনা করব, প্রয়োজন হলে নিজেরাই সমাধান করব। জাতিসংঘের মধ্যস্থতার কথাও উড়িয়ে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। অন্যদিকে সচিবালয়ে সাংবাদিকরা আমির হোসেন আমুর বক্তব্য নিয়ে অবস্থান জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমির হোসেন আমু আমাদের দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। তার এ বক্তব্য নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে, সরকারের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি ১৪ দলের মধ্যেও কোনো আলোচনা হয়নি। এটি সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। 

সম্ভবত এসব কারণেই এরকম একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থান পরিবর্তন করে নিজের বক্তব্যকে তাৎপর্যহীন করেন সরকারদলীয় এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দলীয় এক আলোচনাসভায় তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে কাউকে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়নি। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয়নি, কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত নয় যে দাওয়াত করে এনে খাওয়াব।’ 

সংবাদপত্র পাঠকেরা বিভ্রান্ত হয়ে যান পরস্পরবিরোধী সংবাদ পাঠ করে। ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাই শুধু নন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন তাদের পরস্পরের বক্তব্যের মধ্যে বড় ফারাক দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেমন সংলাপের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, সংলাপ চলমান থাকবে। সংলাপের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, সবকিছুই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কী পরিষ্কার পার্থক্য একের সঙ্গে অন্যের কথার! মনে হয় তাদের নিজেদের মধ্যেই একটা সংলাপ দরকার।  

রাজনীতিতে বিতর্ক থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে। এটাই নাকি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য এখন নির্বাসিত তাই রাজনীতিতে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। সংলাপ হলে কি সমাধানে আসা যাবে আবার সংলাপ নয়, কথার যুদ্ধ কি সংঘাত অনিবার্য করে তুলবে? পরিস্থিতি দেখে দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, শিক্ষা চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধিতে নাকাল মানুষেরা রাজনীতিতে সংঘাত আর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করছে। 


লেখক- সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //