দেশে দেশে কেন এই দাবদাহ

ষাট বছরের উষ্ণতার রেকর্ড ভেঙে যায় গত এপ্রিলে। অথচ বৈশাখের উষ্ণতা এত প্রচণ্ড এত দোর্দণ্ড থাকে না যতটা থাকে জ্যৈষ্ঠমাসে। জ্যৈষ্ঠে প্রকৃতির প্রচণ্ড উত্তাপের সঙ্গে যুক্ত হয় আর্দ্রতা। এক গা জ্বালানো অনুভূতি নিয়ে হাজির হয় দাবদাহ। তাপমাত্রা পারদে যেখানে দেখা যায় ৩৯-৪০ ডিগ্রি, অথচ অনুভূত হয় ৪৪-৪৫ ডিগ্রি। 

শুধু বাংলাদেশ নয় একই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের চেনা আবহাওয়াকে বদলে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা এখন পশ্চিম সাহারার থেকেও বেশি। দাবদাহে এরই মধ্যে ব্যাহত হচ্ছে দেশটির স্বাভাবিক জনজীবন। যুক্তরাজ্যে এক আবহাওয়া বিভাগের পক্ষ থেকে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ইয়র্ক ও ম্যানচেস্টারের আবহাওয়া অফিস লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের বড় অংশজুড়ে দাবদাহের কারণে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। গত বছর এই আবহাওয়াকেন্দ্রিক সতর্কতা চালু করার পর এই প্রথম রেড অ্যালার্ট দেওয়া হলো। এই উচ্চ সতর্কতার মানে হলো চলমান দাবদাহ মানুষ ও অবকাঠামোর ওপর প্রভাব ফেলবে, যার ফলে দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন আনতে হবে। জলবায়ুর এমনই ওলটপালট চলছে গত কয়েক বছর ধরে, যে দাবদাহের সঙ্গে অতীতের কোনো তুলনাই চলে না। কারণ বিশ্বজুড়ে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ আমাদের ক্রমবর্ধমান যন্ত্র সভ্যতা। গোটা পৃথিবীর সামনে এখন একটাই লড়াই তা হলো, বিশ্ব উষ্ণতার বিরুদ্ধে। দিনে দিনে পৃথিবীর উষ্ণতা অসহনীয় হারে বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস মূলত কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রিক অক্সাইড, কার্বন এবং জলীয়বাষ্প এর জন্য দায়ী। বায়ুমণ্ডলে জমেছে গ্রিনহাউস গ্যাস। শিল্প বিপ্লব থেকে আজ অব্দি বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ইন্টার গভর্নমেন্ট প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের মতে, গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে পৃথিবীর জন্য। 

প্রায় একশ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।” 

এ কথা জানতে আমাদের কারও বাকি নেই। তবে এই ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে শুধু গাছ লাগানো, জলাভূমি ভরাট না করার মতো সচেতনতা বা প্রকল্প গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়। কারণ আবার এই পৃথিবীর মানুষ চাইলেই ফিরে যেতে পারবে না অতীতের পৃথিবীতে। তবে এই পৃথিবী যা পারবে তা হলো, অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগুলোকে এক কড়া সতর্ক বার্তা দিতে। শিল্প কারখানায় কয়লা ও ডিজেলের ব্যবহার বিলোপ করতে। 

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব একদিকে মরুভূমিতে যেমন সবুজের ছোঁয়া এনে দিচ্ছে, পাহাড়ে গড়ে উঠছে বন। তেমনি অপরদিকে ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে শীতপ্রধান দেশগুলোতে চলমান প্রচণ্ড দাবদাহে জমে থাকা বরফ গলে ঝুঁকির মুখে পড়ছে বেশ কয়েকটি দেশ। 

ডব্লিউএমওর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেসব দেশ বায়ুমণ্ডলে বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করছে, তাদের উচিত হবে বর্তমানের এই ভয়াবহ তাপপ্রবাহকে একটি আগাম সতর্কসংকেত হিসেবে নেওয়া।

মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলমান দাবদাহের এমন প্রবণতা আরও তীব্র ও নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় কার্বন নির্গমনের জন্য সংস্থাটি বেশি দায়ী করেছে এশিয়ার কয়েকটি দেশকে, যার মধ্যে চীন অন্যতম। 

মাত্র চারটি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বিশ্বের বেশির ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের অতিরিক্ত নির্গমন। ইইউ ছাড়া অপর চার দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত। যার ভেতরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ। বৈশ্বিক নির্গমনের এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী চীন। বিশেষ করে কয়লানির্ভরতার কারণে দেশটির কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন এখনো বাড়ছে। চীনের মাথাপিছু কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ৮ দশমিক ১ টন।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখার লক্ষ্যে নির্গমন কমাতে এই চার দেশ ও ইইউ ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। নজরদারি সংস্থা ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’ বলছে, চীনের নীতি ও পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। সব দেশ যদি একই পথ অনুসরণ করে, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। যদিও চীন ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন ডাই-অক্সাইডনিরপেক্ষ’ হওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে এসব অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগও জরুরি। কারণ এসব দেশ যদি এখনই এই ক্ষতিকর গ্যাস নিয়ন্ত্রণে না আনে, তবে ২০৬০ সালে হয়তো মানবজাতি এর চেয়েও ভয়াবহতা দেখতে পাবে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ হলো শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখা জরুরি। 

কেন জরুরি? কারণ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে শুরু করে ইরানের আহবাজেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। মালদ্বীপ এদের মধ্যে অন্যতম। ইতোমধ্যেই দেশটির সরকার অন্য দেশে জমি কেনার জন্য তহবিল গঠন করছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো দেশটি পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও অন্যতম। এ ছাড়াও এই তালিকার প্রথম দিকে আছে পুয়ের্তোরিকা, মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা। এ ছাড়াও আছে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও নেপাল। 

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) প্রধান পিত্তেরি তালাস মনে করেন, বিশ্বজুড়ে চলমান ভয়াবহ দাবদাহ ২০৬০ সাল পর্যন্ত থাকতে পারে। 

ডব্লিউএমও প্রধান বলেন, ‘মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলমান দাবদাহের এমন প্রবণতা আরও তীব্র ও নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যেতে পারে।’ এবং যদি এমন হয় তাহলে অচিরেই বহু দেশ যে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হবে, বা প্রচণ্ড গরমে পুড়ে গলে যাবে বহু অবকাঠামো এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //