সাংবাদিক নাদিম হত্যার বিচার হবে তো?

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় ৯৮ বারের মতো পিছিয়েছেন আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মহানগর হাকিম রাশিদুল আলম গত ২২ মে এ আদেশ দেন। অর্থাৎ আর মাত্র দুবার পেছালেই এটি শততমর মাইলফলক স্পর্শ করবে এবং সম্ভবত পৃথিবীর বিচারিক ইতিহাসে রেকর্ড করবে।

গণমাধ্যমে এই সংবাদটি আসার এক মাস না যেতেই গত ১৪ জুন রাতে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় গোলাম রব্বানি নাদিম নামে এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাংবাদিককে হত্যা করতে সাহস লাগে। হত্যা করার পর পার পেয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক সক্ষমতা লাগে। যে কারণেই হয়তো প্রায় এক যুগেও সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরা সম্ভব হয়নি। এমনকি কারা তাকে খুন করল সেটিও জানা সম্ভব হয়নি। অথবা জানা সম্ভব হলেও তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে নিহত হন দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। শোনা যায়, শিমুল দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় অস্ত্র মহড়ার ছবি তুলতে গেলে পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা হালিমুল হকের অস্ত্রহাতে ছবি তুলছিলেন, এতে পৌর মেয়র হালিমুল হক রাগে সাংবাদিক শিমুলকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। যেভাবেই হোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ফলেই যে এ ঘটনা, এটিই সত্য। শিমুল লাঙল চালিয়ে চাষাবাদ করতেন এবং সেই সঙ্গে সাংবাদিকতা। নাট্যকর্মী হিসেবেও তার সুনাম ছিল। কিন্তু শিমুলের খুনিরা ছাড়া পেয়ে গেছে। তাদের প্রধান হোতা হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন শাহজাদপুরের তখনকার মেয়র হালিমুল হক মিরু। তিনিও ২ বছর সাড়ে ৯ মাস কারাভোগ করে জামিনে ছাড়া পান।

সেই খুনের তালিকায় এবার যুক্ত হলো গোলাম রব্বানি নাদিমের নাম। গত ১৪ জুন রাত সোয়া ১০টার দিকে একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি মারধরে তিনি নিহত হন। তিনি অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর জামালপুর জেলা প্রতিনিধি এবং একই সঙ্গে একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করতেন।

তবে আশার সংবাদ হলো, ঘটনার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অস্বীকার করার উপায় নেই, পুলিশের এই তৎপরতার পেছনে প্রধানত দুটি বিষয় চাপ তৈরি করেছে। ১. নিহত সাংবাদিক নাদিম দেশের দুটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে কাজ করতেন এবং ২. তাকে হত্যার ঘটনাটি সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। ফলে যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, গোলাম রব্বানি নাদিম যদি অপেক্ষাকৃত ছোট বা স্থানীয় কোনো পত্রিকার সাংবাদিক হতেন এবং ঘটনাটি যদি সিসি ক্যামেরায় ধরা না পড়ত, তাহলে কি এত দ্রুত অপরাধীরা ধরা পড়ত?

স্মরণ করা যেতে পারে, সিলেটে রাজন নামে এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা, নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানো, সিলেটে খাদিজা নামে একজন কলেজছাত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো কিংবা বরগুনায় রিফাত নামে এক তরুণকে প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাগুলো সারা দেশে তোলপাড় তুলেছিল এবং এসব ঘটনায় দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছিল। কারণ এই সবগুলো ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ ছিল। কিন্তু যদি রদৃশ্যগুলোর কোনো ভিডিও না থাকত; কারও মোবাইল ফোন কিংবা সিসি ক্যামেরায় ধরা না পড়ত, তাহলে এইসব ঘটনার বিচার এখনো কি শেষ হতো?

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে বাসায় ঢুকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রায় এক যুগেও বিচার তো দূরে থাক, অপরাধীদের শনাক্তই করা যায়নি। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনু নামে যে কলেজছাত্রী নৃংশসভাবে খুন হয়েছেন, তারও কোনো কূলকিনারা হয়নি। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো ভিডিও ফুটেজ থাকলে একদিনে নিশ্চয়ই বিচার সম্পন্ন হয়ে যেত। তার মানে এখন কি ভিডিও ফুটেজ বা সিসি ক্যামেরার ছবি ন্যায়বিচার পাওয়ার একটি প্রধান শর্তে পরিণত হলো? তাহলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত এবং পুরো বিচারিক প্রক্রিয়ায় যেসব মানুষ যুক্ত থাকেন, তাদের কাজ কী? 

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, সাংবাদিক নাদিমের ওপর আক্রমণ হয়েছে এবং সেই ছবি দেখেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সিসি ক্যামেরায় যদি এই ঘটনা ধরা না পড়ত, তাহলে কি আদৌ তাদের অভিযুক্ত করা বা তাৎক্ষণিকভাবে ধরা হতো?

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে এবং নিহত ব্যক্তি দুটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের কর্মী ছিলেন বলে স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবেও এর দারুণ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আশা করা যায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও তুলনামূলকভাবে দ্রুতই সম্পন্ন হবে এবং অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেসব ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ নেই; যেসব নিহত ব্যক্তির সামাজিক-রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বড় পরিচয় নেই; ক্ষমতার সঙ্গে যার বা যাদের যোগসূত্র কম, সেরকম মানুষদের পরিবারগুলো কি স্বজন হত্যার ন্যায়বিচার পাচ্ছে? নানারকম রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে অপরাধীকে আড়াল করা কিংবা নিরপরাধকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার ঘটনাও ভূরি ভূরি। উপরন্তু যে কোনো ঘটনায় নিজেদের দায় এড়ানোর সংস্কৃতিও বহু পুরনো। ফলে এতসব বাধা অতিক্রম করে একজন সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সত্যিই কঠিন। 

অবশ্য বিচারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভালো মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। কিন্তু ভালো মানুষদের ওপরেই সবচেয়ে বেশি চাপ থাকে। রাজনীতি ও দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহভাবে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা থাকার পরও অনেক সময়ই নানাভাবে তাদেরকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়। অনেক সময় তাদেরকে আপস করতে হয়, এই অভিযোগও নতুন নয়। ফলে এখন কোনো অপরাধের ভিডিও ফুটেজ বা সিসি ক্যামেরায় ছবি না থাকলে দ্রুততম সময়ে অপরাধীরা ধরা পড়বে কি না বা তাদের চিহ্নিত করা গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরবে কি না বা ধরতে পারবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন।

আরও যে প্রশ্নটি নাগরিকদের মনে আছে তা হলো- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে এই দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং যে আদর্শগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে গত ৫২ বছরে দেশ কতখানি এগোল? খুব বেশি যে এগোয়নি তার প্রমাণ প্রকাশ্যে একজন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলছেন ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। অর্থাৎ সবকিছুকেই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দায় এড়ানোর যে অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেখান থেকে দেশকে মুক্ত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //