প্রবাসী, পরকীয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া

আমি একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, যার বিষয় হচ্ছে প্রবাসীদের জীবন ও সমস্যা। আমার ফোকাস অভিবাসন প্রক্রিয়া। কিন্তু তারপরও সামাজিক বাস্তবতার বিষয়টি আসে, আসছে। তাদের জীবনে কী কী পরিবর্তন হয়-ভালো-মন্দ, কেমন থাকে তারা এই সব। টাকা ইনকাম ছাড়া, প্রবাসীদের জীবন নানা ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত, নেতিবাচক অনেক কিছু ঘটে। লোকজন পরকীয়ার কথাই বেশি বলে, কারণ সামাজিকভাবে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটা মানুষকে আঘাত দেয় অনেক। অতএব প্রবাসী জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কাজ করলে এই সব বিষয় আসবেই।

দুই

আমি একটি সেমিস্টার পড়াই, যার বিষয় সামাজিক যোগাযোগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বিগত ১০-১১ বছর ধরে পড়াচ্ছি। কিন্তু এই বিষয়টিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে, তাই পাঠও পাল্টেছে, বিশেষ করে মানুষের যোগাযোগ পদ্ধতিতে। মানুষ একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে টিভি দেখে মোবাইল ফোন বা ডিভাইসের মাধ্যমে। এটি এখন জীবনের অংশ। তাই যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সংবেদনশীল। অতএব এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের কাছে কীভাবে বার্তা দেওয়া যায় সেটা আমার পাঠদানের বিষয়। আর যেহেতু আমি হাতে কলমে শেখাই তাই আমাকেও যেতে হয়েছে এই সামাজিক মিডিয়ার দুনিয়ায়, বিশেষ করে ফেসবুক ভিডিও দুনিয়ায়।

তিন

সামাজিক যোগাযোগের দুনিয়ায় অনেক পথ ও পরিসর আছে। আমি কেবল দুটোকেই চিনি। ইউটিউব যেটা গানে ভরা আর ফেসবুক যেটা গালিতে ভরা। বাংলাদেশের মানুষ যে কি নোংরা ভাষায় গালি দিতে পারে সেটা ভাবা যায় না। প্রায় সবাই করে এটা তা নয়, তবে অনেকেই করে। সবচেয়ে বেশি করে পলিটিক্স নিয়ে। সত্য-মিথ্যা জানার দরকার নেই, গালিটাই আসল। গালি আমাদের যুক্তি-তর্কের বিকল্প।

চার

গবেষণায় আরও মনে হচ্ছে যে আমাদের অর্থ, ক্ষমতা, আহার, ভয় ও ঘৃণা প্রীতি ভীষণ বেড়েছে। তাই সবাই সবার শত্রুতে পরিণত হয়েছে, নিজের ভাগের জন্য লড়তে। সমাজের কী হবে জানি না, তবে আর্থিক উন্নতি হবেই, কারণ এরকম জান-প্রাণ দিয়ে অর্থ-বিত্ত সন্ধানী জনগোষ্ঠী কমই আছে। কোনো কিছুতে কারও আপত্তি নেই যদি শেষমেশ কিছু প্রাপ্তি হয়। নৈতিক বা আইনি উপার্জন বলে কিছু নেই, আছে আয়। যেভাবে টাকা আসে আসুক, আসলেই হলো। অর্থাৎ এই সমাজ জানে সে কী চায়। টাকা চায়, ক্ষমতা চায় আর এই দুই হলে, উপভোগ ভোগ করতে চায়। এমনভাবে চায়নি কোনোদিন, এমনভাবে পায়নিও কোনোদিন। 

পাঁচ

সোশ্যাল মিডিয়া কত প্রভাবশালী সেটা জানি বলেই পড়াচ্ছি। তবে ভিডিও সেকশনে আমার যাতায়াত কম। যে সব ভিডিও আপলোড হয় সেটা আমার কাছে এক আলাদা দুনিয়ার পরিচায়ক। আজকাল ঢাকা থেকে যেমন কনটেন্ট আপলোড হয়, ঢাকার বাইরে থেকেও হয়। তাছাড়া আছে বিদেশ। অতএব সব মিলিয়ে গোটা বাংলাদেশের চেহারাটা দেখা যায় এখানে। রাজনীতি আছে, কিন্তু সেটাও গালিতেই ভরা। বহু প্রবাসী আছেন যারা কোরিয়া, মালয়েশিয়া, কানাডা, বিলাত, আমেরিকা থেকে প্রতিদিন আপলোড করেন। এদের নিজস্ব টক শো আছে, প্রচুর ফলোয়ার। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কনটেন্ট পরকীয়ার ওপর। ইন্ডিয়াতেও এই বিষয় কন্টেন্ট আছে। ইন্ডিয়া-বাংলা পরকীয়ার কেস আছে। ওখান থেকে এসে এখানে প্রেম, ক্রস কান্ট্রি পরকীয়া বলা যায়। বোঝা যায় পলিটিক্স আর পরকীয়া সোশ্যাল মিডিয়ার প্রধান খাদ্য। 

ছয়

অনেক কিসিমের পরকীয়া কেস আছে। তবে অনেকগুলো হচ্ছে প্রবাসীদের নিয়ে। ঢাকার বাইরে গ্রামসহ সব স্থানের রিপোর্ট আছে। স্বামীর অবর্তমানে রাতে কেউ আসে, স্ত্রী না থাকলে অন্য কারও বাড়িতে নিশি ভ্রমণ, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি। আবার শহরে হোটেলে কেস ধরা পড়ে প্রেমিক বা যৌনকর্মী নিয়ে। এই কিচ্ছার শেষ নেই। কনটেন্ট হিসেবে এক হচ্ছে পরকীয়ার ওপর সংবাদ চিত্র, অন্যটা হচ্ছে নাটক। বেশির ভাগ হচ্ছে নারী কেন্দ্রিক। স্বামী বিদেশে, স্ত্রী পরকীয়ায়, ধরা, তারপর...। নাটকে ধরা পড়ার পর ভুল বুঝে ক্ষমা চায় স্ত্রী কিন্তু পায় না, তাকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর অন্য ভিডিওতে যান।

সাত

বছর পাঁচেক আগে আমি ‘পরিবার ভাবনা’ নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলাম, যাতে জানা যায় যে ‘মানুষের মনে আর্থিক আকাক্সক্ষা, সম্পর্কজনিত দুশ্চিন্তা ও অবিশ্বাস এবং মুখে এক কাজে অন্য’ ভাব প্রচণ্ডরকম বাড়ছে। ভায়োলেন্স বাড়ছে এসব কারণে। নৈতিকতা ‘একটি চিরন্তন সত্য, সমাজ ও ইতিহাসের ঊর্র্ধ্বে’, এমনটা মানুষ ভাবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

আট

মানুষ অনেক চায়, সর্বক্ষেত্রে। এটা বিশ্বব্যাপী সত্য। পশ্চিমা সমাজেও ভীষণ অস্থিরতা। ওদের সোশ্যাল মিডিয়াতে গেলে একই বিষয় পাবেন। আমাদের মিডিয়াতেও তাই। মানুষ যাকে খারাপ কাজ/পাপ বলে, এটা এখন সবার গণতান্ত্রিক অধিকার ও চর্চা। সবাই ভোগের সন্ধানে ব্যস্ত। প্রবাসীদের ধরা সোজা, ওরা দেশে থাকে না। সবার চোখ ওদের বাড়ির দিকে। যারা এখানে, তারা লুকাতে পারে। তাও প্রচুর ধরা পড়ে। আমাদের পরকীয়া হার কত কেউ জানে?

নয়

এই দেশে চুরি, খুন, বাটপারির সাজা হয়। কিন্তু খুব কম। যাদের এটা দেওয়ার কথা তাদের ক্ষমতা, ইচ্ছা ও দক্ষতা তিনটারই অভাব। প্রাতিষ্ঠানিক আইনি কাঠামো খুবই দুর্বল। তাহলে থাকে সমাজ। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনশীল, ভাবনায়, ব্যক্তিত্বে। অনেক কিছু মেনে নেয়, মানতে বাধ্য হয় অথবা মানতে চায়। বাকি থাকে ব্যক্তি। কেবল ঐখানেই কিছুটা আলাদা। অর্থাৎ আমাদের সমাজে ‘নৈতিকতা’ একান্তই নিজস্ব বিষয়। সমাজের কোনো ভ‚মিকা নেই। হলেও পুরস্কার নেই, না হলে লাভ হবে।

দশ

তবে পৃথিবীতে পরকীয়ার চেয়ে আরও বড় পাপ আছে। আর শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত ছেলেরা সমানভাবে জড়িত। তাহলে মেয়েদের নিয়ে কেন এত ভিডিও? কারণ এর ভক্ষক ছেলেরাই বেশি। শেষ কথা বাজার। চাহিদার ওপর কোনো সত্য নেই সেটা লাভ হোক অথবা লালসা।

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //