হজ ও কোরবানির তাৎপর্য

মুসলিম মিল্লাতের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষের শুভ বারতা নিয়ে আগমন করে হিজরি বর্ষপঞ্জির শেষ মাস জিলহজ।  এ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে হজ ও কোরবানির দিন। জিলহজের ৯ তারিখ পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়  এবং পরদিন ১০ তারিখ উদযাপিত হয় ঈদুল আজহা। সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এ দুটো দিন আগমন করে গভীর তাৎপর্য ও সুদূরপ্রসারী বার্তা নিয়ে।

হজ আল্লাহপ্রেমে ব্যাকুল বান্দাদের আকুল অভিব্যক্তির ইবাদত। খোদায়ী সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার মহড়া চলে সজ্জা ও শোভার সব ভূষণ ত্যাগের মাধ্যমে। নওয়াব-নফর, বাদশাহ-ফকির নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে একই সাদাসিধে পোশাক পরে আল্লাহর ঘরের চারপাশে অস্থিরভাবে পরিভ্রমণ করে। একই আদম-হাওয়ার সন্তান একই পরিবারের সদ্য হিসেবে তারা সাম্য ও মৈত্রীর যে নমুনা পেশ করে, তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো সমাবেশের সঙ্গে হতে পারে না।

এ জন্য বায়তুল্লাহর হজ একদিকে যেমন ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চ মাকাম, তেমনি মানবসাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তপ্ত মরুর বিস্তীর্ণ ময়দানে সারা পৃথিবী থেকে আগত মানুষেরা বর্ণ গোত্র ও আঞ্চলিক সীমারেখা ঘুচিয়ে একই সুরে একই বেশে আরাধনা জানাতে থাকে পরম করুণাময়ের দরবারে। লাব্বাইক লাব্বাইক বলে তারা নিজের শুধু উপস্থিতির ঘোষণাই দেয় না, বরং দুনিয়াবী জিন্দেগীর প্রতি নির্মোহ মনোভাব ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুলতাও প্রকাশ করে। 

জিলহজ মাসে রয়েছে আরেক ইবাদত। তা হলো ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও  ১২-এ তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবাই করাই কোরবানি হিসেবে আখ্যায়িত। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরতের পর থেকে প্রতিবছর কোরবানি করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’

কুরআন মজীদে কোরবানির বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: আমরা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তোমরা  তাঁরই আজ্ঞাধীন থাকবে। আর (হে নবী) আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ দিন। যাদের অন্তর আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে ভীত হয় এবং যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে এবং নামাজ কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। এবং উটকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি।

এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে। তারপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তা থেকে তোমরা আহার করবে এবং আহার করাবে যে যাত্রা করে না এবং যে যাত্রা করে। এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের সুপথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং (হে নবী), সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৭)

মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। দুই ঈদের প্রবর্তন প্রসঙ্গে হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) মদীনায় আগমন করার আগে এখানকার বাসিন্দাদের দুটি দিন ছিল। এ দিন দুটিতে তারা খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদ করত। এটা দেখে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিন কী? তারা বলল, ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়্যাতের সময় এ দুটি দিনে আমরা খেলাধুলা করতাম। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এই দুদিনের পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য আরও ভালো দুটি দিন দান করেছেন। এর একটি হলো ঈদুল আজহার দিন ও অপরটি ঈদুল ফিতরের দিন। (আবূ দাঊদ শরীফ)

ঈদের সালাত আদায়ে আল্লাহর রাসূলের নিয়ম প্রসঙ্গে হজরত আবূ সা’ঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন (ঘর থেকে) বের হয়ে ঈদগাহের ময়দানে গমন করতেন। প্রথমে তিনি (সা.) সেখানে গিয়ে (সবাইকে নিয়ে) সালাত আদায় করতেন। এরপর তিনি মানুষের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন। মানুষেরা তখন নিজ নিজ সারিতে বসে থাকতেন। তিনি তাদেরকে ভাষণ  শোনাতেন, উপদেশ দিতেন। আর যদি কোনো দিকে সেনাবাহিনী পাঠানোর ইচ্ছা করতেন, তাহলে তাদের নির্বাচন করতেন। অথবা কাউকে কোনো নির্দেশ দেওয়ার থাকলে তা দিতেন। তারপর ঈদগাহ হতে ফিরে আসতেন। (বুখারী ও  মুসলিম শরীফ)

কোরবানির মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন; কোরবানির দিনে আদম সন্তানেরা এমন কোনো কাজ করতে পারে না যা আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত করার (অর্থাৎ কোরবানি করা) চেয়ে বেশি প্রিয় হতে পারে। কোরবানির পশু শিং, লোম ও  খুরসহ  কেয়ামতের দিন হাজির হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর নিকট মর্যাদাকর স্থানে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা সানন্দে কোরবানি করবে। (তিরমিযী ও  ইবনে মাজা শরীফ)

তেমনি হজরত জায়দ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ কোরবানিটা কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে?  তিনি বললেন, কোরবানির পশুর প্রত্যেকটি  লোমের পরিবর্তে একটি করে প্রতিদান রয়েছে। পশমওয়ালা পশুদের প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে  মাজা শরীফ)

এসব আয়াত ও হাদিসের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক  যে মুসলমান (পুরুষ-মহিলা) কোরবানির দিনে নেসাবের মালিক, তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। নেসাবের মালিক বলতে অত্যাবশ্যকীয় বাসগৃহ ও ব্যবহার্য আসবাব-সামগ্রী বাদ দিয়ে যার মালিকানায় ৫১২.৩৫ গ্রাম (৫২.৫০ তোলা) রৌপ্য বা ৮৭.৪৯৭ গ্রাম (৭.৫০ তোলা স্বর্ণ বা উল্লিখিত রৌপ্যের সমমূল্য পরিমাণ মাল-সম্পদ কোরবানির দিনসমূহে থাকবে, তাকেই (এ ক্ষেত্রে) নেসাবের মালিক বলা হবে। 

স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা, ব্যবসার পণ্য এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাবসামগ্রী সব মিলেও যদি ৫১২.৩৫ গ্রাম রৌপ্যের মূল্যের সমপরিমাণ হয়, তাহলেও কোবরানি ওয়াজিব হবে। ব্যবসার নিয়তে ক্রয়কৃত গরু ছাগল ও স্থাবর সম্পত্তি যেমন বাড়ির ফ্ল্যাট ইত্যাদিও ব্যবসার পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। নাবালেগ, পাগল ও মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।  জিলহজের ১২ তারিখ পর্যন্ত নেসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। কোরবানি ও ফেতরার জন্য মাল পূর্ণ এক বছর মজুদ থাকা শর্ত নয়।  মালদার হলেও মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কিন্তু ১২ তারিখের সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে ফিরলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। নাবালেগ ছেলে-মেয়ে মালদার হলেও তাদের সম্পদ ও অর্থ থেকে  কোরবানি করা যাবে না।

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা যেতে পারে। কারও পক্ষ হতে তার অনুমতি ব্যতীত ওয়াজিব কোরবানি শুদ্ধ  হবে না, বরং গরুতে শরিক করলে সমস্ত অংশের কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য নফল বা সওয়াব পৌঁছানোর জন্য কোরবানি করলে অনুমতি নিতে হবে না। কোন উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করার পর সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে কোরবানি করা ওয়াজিব।

ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //