বিশ্বের জলবায়ু তহবিলে শিশুদের প্রয়োজন উপেক্ষিত

বিশ্বে এখন জলবায়ু সংকটের এক ভয়াবহ দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আর এই ইস্যুতে সোচ্চার ও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে  বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একাত্মতা ঘোষণা করলেও বাস্তবিকে শিশুদের ক্ষেত্রে যেন তেমন সুফল মিলছে না বিশ্বজুড়ে। একটি সুন্দর বিশ্বের আগামীর প্রতিনিধিরা হলেন শিশু। অথচ তাদের নিয়ে চিন্তাশীল ভাবনার মধ্যে বেশ একটা খামতি ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। আর এ বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফ কাজ করে আসছে বহু সময় ধরে। যার ধারাবাহিকতায় শিশুদের প্রয়োজনগুলোকে সামনে রেখে গুরুত্বের সঙ্গে সংস্থাটি বিশ্ব দরবারের কাছে শিশু তহবিল যোগাতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  

আর সে সূত্র ধরেই চিলড্রেনস এনভায়রনমেন্টাল রাইটস ইনিশিয়েটিভ (সিইআরআই) জোটের সদস্য প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউনিসেফ প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জলবায়ু সংকটের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা পাচ্ছে না প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল।

প্রতিবেদনটিতে মূল বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের মাত্র ২.৪ শতাংশ শিশুদের জন্য রাখার প্রস্তাবও করা হয়। ইউনিসেফের শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, ১০০ কোটির বেশি শিশু জলবায়ু সংকটজনিত প্রভাবের অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। 

এ বিষয়ে ইউনিসেফ শিশু অ্যাডভোকেট বার্বাডোসের জলবায়ু কর্মী ১৩ বছর বয়সী মারিয়া মার্শাল জানান- শিশুরাই ভবিষ্যত, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে বর্তমান সময়ে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাদের কার্যক্রমের উপর এবং আমাদের কথা শোনা হচ্ছে না। এই প্রতিবেদন যেমন বলছে, জলবায়ুজনিত সংকট সমাধানের জন্য অর্থায়ন একটি বাধ্যবাধকতা, কিন্তু সেই অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হয় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের প্রয়োজন ও দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এদিকে ইউএনএফসিসিসি এবং প্যারিস চুক্তি অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ বহুপাক্ষিক জলবায়ু তহবিলগুলো (এমসিএফএস) থেকে জলবায়ু অর্থায়ন করা হয়েছে কিনা তা মূল্যায়ন করতেই ‘তহবিল কমছে: শিশুদের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের ঘাটতি মোকাবিলা’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় তিনটি মানদণ্ডের একটি সেট ব্যবহার করা হয়। 

এগুলো হলো– জলবায়ুজনিত সংকটের ফলে শিশুরা যে ঝুঁকিগুলোতে পড়বে তা মোকাবিলা করা, শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সেবাসমূহ শক্তিশালী করা এবং পরিবর্তনের দূত হিসেবে শিশুদের ক্ষমতায়ন বাড়ানো।

এ প্রসঙ্গে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বসু বলেন, সমীক্ষায় উঠে আসা বিষয়গুলো বেশ অপ্রীতিকর। জরুরি ও কার্যকর বিনিয়োগ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চাবিকাঠি এবং শিশুদের জন্য, বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্য, যারা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ঝুঁকিতে আছে তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও বর্তমানে যে তহবিল ব্যয় করা হয় সেখানে শিশুদের প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়‒ এর পরিবর্তন দরকার।

প্রতিবেদনটিতে ওঠে এসেছে, ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৭ বছর ধরে জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর জন্য এমসিএফএসের মাধ্যমে প্রদত্ত সমস্ত অর্থের শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ (২.৪%) তিনটি প্রয়োজনীয়তার সবগুলোই পূরণ করেছে, যার পরিমাণ মাত্র ১২০ কোটি ডলার। 

সেভ দ্য চিলড্রেন-এর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গ্লোবাল হেড কেলি টুলি বলেন, শিশুরা বিশেষ করে যারা ইতোমধ্যেই অসমতা ও বৈষম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে কম ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু তারাই এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  জলবায়ু অর্থায়ন শিশুদের প্রয়োজন ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে এই অবিচারগুলো মোকাবিলা করার একটি সুযোগ তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি আজ অবধি অপর্যাপ্ত।

উল্লেখ্য, এমসিএফগুলো সামগ্রিক জলবায়ু অর্থায়নের একটি অপেক্ষাকৃত ছোট অংশের যোগান দিয়ে থাকে। তবে এই তহবিলগুলো যে মাত্রায় শিশুদের বিষয়টি বিবেচনা করে তা অপরিসীম ভূমিকা রাখে। মূলত সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে অনুঘটক ও সমন্বয় করতেই এমসিএফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

বর্তমান বিশ্বে শিশুরা পানি ও খাদ্য অভাবের পাশাপাশি পানিবাহিত রোগ এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে  অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে। 

এমনকি আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের ফলে শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশুদ্ধ খাবার পানির মতো মৌলিক পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ইউনিসেফের ইউনিসেফের জলবায়ু অ্যাডভোকেসির বিশেষ উপদেষ্টা পালোমা এসকুদেরো বলেন, প্রতিটি শিশুই অন্তত একটি এবং অনেক ক্ষেত্রে একাধিক জলবায়ুজনিত বিপত্তির সম্মুখীন। আর জলবায়ুজনিত বিপত্তির সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিষেবাগুলোকে খাপ খাইয়ে নিতে যে অর্থায়ন ও বিনিয়োগের প্রয়োজন তা অপ্রতুল। যা দিয়ে শিশুদের জরুরি ও অনন্য প্রয়োজনগুলোর বেশিরভাগই পূরণ করা সম্ভব হয় না। এটি অবশ্যই বদলাতে হবে। 

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যখন শিশুদের কথা আসে, তখন তাদের সক্রিয় অংশীজন বা পরিবর্তনের দূত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে প্রায়ই একটি অরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়। একইসঙ্গে ৪ শতাংশেরও কম প্রকল্প তাদের জন্য রয়েছে। যার পরিমাণ এমসিএফ বিনিয়োগের মাত্র ৭ শতাংশ (২৫৮ কোটি ডলার)। 

প্রতিবেদনটি প্রস্ততের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিশুদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাদের ভাষ্যে দেখা যায়, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়ে জিম্বাবুয়ের এক কিশোরী বলেন, “চিরেদজিতে আমরা শিখেছি যে কিছু মেয়ে স্কুলে বা বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্লাবিত নদীতে সাঁতার কাটতে পারে না, যেখানে ছেলেরা তা পারে। স্কুলে যাওয়ার জন্য মেয়েদের ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তারা এমনকি ক্লাস শুরু করার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর বলছেন, "আমাদের জেলায় বড় ধরনের অনেক দুর্যোগ আঘাত হানে, যার কারণে মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ায় আমাদের মতো শিশুরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে।

এদিকে সিইআরআই জোট বহুপাক্ষিক জলবায়ু তহবিলের পাশপাশি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে জলবায়ু অর্থায়ন প্রদানে অন্যান্য জলবায়ু অর্থায়নকারীদেরকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি রয়েছে তা মোকাবিলায় কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। 

মূলত চিলড্রেনস এনভায়রনমেন্টাল রাইটস ইনিশিয়েটিভ (সিইআরআই) হলো শিশু ও তরুণ-তরুণী, জলবায়ু কর্মী, শিশু অধিকার সংস্থা, বিশেষজ্ঞ, সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও বিশ্বের নানা প্রান্তের নীতি নির্ধারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। এই জোট নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশে সৃষ্টির জন্য শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করে থাকে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //