জাতিগত সংঘাতে বিশ্ব অস্থির

ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত মে মাসে যে জাতিগত সহিংসতায় সৃষ্টি হয় তা এখনো থামেনি। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট সেবা স্থগিত করা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটদের দেখামাত্র গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন মারা গেছেন। মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায় যারা মণিপুরের জনসংখ্যার অর্ধেক, তাদের তপশীলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হাইকোর্টের সুপারিশ করার পর থেকেই সহিংসতা চলছে।

পুরো রাজ্যেই সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে, টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী ও কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য। কিন্তু সহিংসতা থামছে না, মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এই সহিংসতায় মণিপুরের সাবেক এক মুখ্যমন্ত্রী সন্দেহ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন, মণিপুর রাজ্য আদৌ ভারতের অন্তর্ভুক্ত কিনা!

মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠীর বসবাস মূলত ইম্ফল উপত্যকায়। তারা দীর্ঘদিন ধরে তপশীলি উপজাতি হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু এই উপজাতি প্রকৃতপক্ষে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নয়। পাহাড়ি অঞ্চলে যে আদিবাসীরা বসবাস করে তাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে কুকি চিন জনগোষ্ঠীর মানুষ। অবশ্য ইম্ফল উপত্যকায় নাগা কুকিসহ আরও কয়েকটি উপজাতি গোষ্ঠী বসবাস করে। আদালতের সুপারিশে মেইতেইরা উপজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গেলে পাহাড়ি অঞ্চলের প্রকৃত উপজাতিরা বঞ্চিত হবে-এই আশঙ্কা থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। তালিকাভুক্ত উপজাতিগুলোর জন্য সরকারি চাকরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা আছে।

এছাড়াও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পাহাড়ি অঞ্চলে শুধু উপজাতিদের জমির ওপর অধিকার রয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর ভয় হচ্ছে মেইতেইরা তালিকাভুক্ত উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলে তাদেরও জমির ওপর অধিকার বর্তাবে, তারাও পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করবে, বসবাস গড়তে গিয়ে তারা বনজ সম্পদ ধ্বংস করবে।

এ ছাড়াও পাহাড়ি এলাকা থেকে সরকার বেআইনি দখলদারদের সরাতে গিয়ে নাগা এবং কুকিদের উচ্ছেদ করছিল-সরকারের এই উচ্ছেদ কর্মকাণ্ড উপজাতিদের ক্ষোভের আরেকটি কারণ। এমন ক্ষোভের মাঝে হাইকোর্টের সুপারিশ উপজাতিদের সহিংস করে তোলে। 

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই পশ্চাতে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকতর সুবিধা দিয়ে জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা অন্য যে কোনো নাগরিকের চেয়ে বেশি। শিক্ষা অর্জন এবং চাকরির ক্ষেত্রে আমাদের দেশেও নারী এবং উপজাতিদের জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকত, এছাড়াও ছিল জেলা কোটা।

দীর্ঘদিন যাবৎ সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো যাতে অগ্রাধিকার পেয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাতারে উঠে আসতে পারে সেজন্য কোটার সংরক্ষণ অপরিহার্য ছিল। নির্বাচনের ক্ষেত্রে খেলার মাঠের সমতার জন্য সোচ্চার হলেও শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু লোকগুলো অসম মাঠ পছন্দ করে থাকে, দুর্বল করে রাখা জনগোষ্ঠীর জন্য রাখা কোটা উঠে গেল।

মণিপুরের অগ্রগামী মেইতেইদের সঙ্গে কুকি চিন ও অন্যান্য উপজাতির পক্ষে প্রতিযোগিতা করে শিক্ষা লাভ ও চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিদ্যমান অগ্রাধিকার সুবিধা তারা হারাতে চায় না-তাই প্রতিযোগীকে সহ্য করতে পারছে না। 

জাতিগত সহিংসতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে, বিশেষ করে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা। এই দেশটিতে তিনটি সম্প্রদায়ের বাস। মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। হুতু মোট জনসংখার প্রায় ৮৫%, তুতসি ১৪% এবং তাওয়া প্রায় ১%। দেশটি দখল করে বেলজিয়াম; বেলজিয়ামের শাসনামলে তুতসিরা শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা ও চাকরির ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা লাভ করে, বেলজিয়াম তাদের বনেদি হিসেবে আখ্যায়িত করলে তুতসির প্রতি সংখ্যাগুরু হুতুদের ঘৃণা জন্মাতে থাকে। ১৯৬২ সালে দেশটি বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে তুতসিদের ক্ষমতা খর্ব হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৯০ সালে ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ উগান্ডায় দীর্ঘ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে রুয়ান্ডায় প্রবেশ করে। শুরু হয় সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। 

১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে রুয়ান্ডার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে ফেরার পথে রাজধানী কিগালি এয়ারপোর্টে বিমান অবতরণের আগমুহূর্তে আততায়ীর ছোড়া দুটি মিসাইলের আঘাতে প্রাণ হারান; হুতুরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তুতসিদের দায়ী করে। এই ঘটনায় রুয়ান্ডার জাতিগত দাঙ্গা গণহত্যায় পর্যবসিত হয়, এই দাঙ্গায় প্রায় ৮ লাখ লোক প্রাণ হারায়। এই দুই নৃগোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধে হুতুদের সহায়তা করে ফ্রান্স এবং তুতসিদের সহায়তা করে উগান্ডা। সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের ওপর।

মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে আট লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে, এই দৃশ্য টিভিতে দেখে তখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। হুতুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তুতসিরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছিল, হুতু স্বামী তার তুতসি স্ত্রীকে হত্যা করেছে।

এ হত্যাযজ্ঞে প্রায় ২ লাখ নারী ধর্ষিত হয়, ১ লাখেরও অধিক শিশুকে খুন করা হয়। গণহত্যা মোকাবিলার মতো রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না, সৈন্য ছিল মাত্র ২৫০০ জন। শান্তিরক্ষী বাহিনী কার্যত দাঙ্গা থামাতে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি, তাদের চোখের সামনেই হত্যাযজ্ঞ চলে। বিশ্বের মোড়লেরা এই গণহত্যাকে তখন গুরুত্ব দেয়নি, তারা ধারণাও করেনি যে এভাবে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কচুকাটা করা হচ্ছে, যখন উপলব্ধি করল তখন আর কিছু করার সময় ছিল না। 

রুয়ান্ডার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামের নেতৃত্বাধীন রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট উগান্ডা থেকে এসে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিলে ১০০ দিন ধরে চলমান গণহত্যার অবসান ঘটে। রুয়ান্ডার জাতিগত দাঙ্গা কত নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিল তা সেখানকার চার্চ এবং চার্চের যাজকদের কর্মকাণ্ড থেকেই প্রতীয়মান হয়; সেই দাঙ্গায় চার্চ এবং চার্চের যাজকদের অনেকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, চার্চে আশ্রয় নিতে আসা মানুষদের তারা নিজেরাই হত্যা করেছিল।

জাতিগত দাঙ্গায় দাঙ্গাবাজেরা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, ধর্মের অমিয় বাণী তখন পুরোহিতদেরও মনে থাকে না, ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক দেখলেই ধারালো অস্ত্র চালায়, গর্দান দুই ভাগ করে দেয়। সেই সময়  রুয়ান্ডার মুসলিম কমিউনিটি নিরপেক্ষ ভ‚মিকা নিয়ে গোপনে অসহায় তুতসিদের আশ্রয় দিয়েছে। মুসলমানদের এমন মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ দেখে রুয়ান্ডার সাধারণ মানুষ পরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।

১৯৯৪ সালে  রুয়ান্ডায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ, আর এখন সেই সংখ্যা ৭ লাখে পৌঁছেছে। ইয়েমেন, কঙ্গো, সুদান, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডাসহ আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি দেশে জাতিগত সংঘাত চলছেই। 

১৯৯২ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা যুগোসøাভ প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা লাভ করে; স্বাধীনতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে বসনীয় মুসলমান, ক্রোয়েশীয় এবং সার্ব খ্রিষ্টানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং এই যুদ্ধ ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সার্ব বাহিনী বসনিয়ান মুসলিম ও ক্রোয়েশীয় খ্রিষ্টান বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালায়; এই গণহত্যায় প্রায় ১ লাখ লোক মারা যায়, যাদের শতকরা ৮০ ভাগই ছিল বসনিয়াক মুসলমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এত বড় গণহত্যা আর হয়নি। এ ছাড়াও অসংখ্য নারীকে সার্ব সেনারা ধর্ষণ করেছে। বর্তমানে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বসনিয়াক, সার্ব এবং ক্রোয়াট-এ তিনটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হলেও জাতিগোষ্ঠী তিনটির মধ্যে বিদ্বেষ ও বিভাজন নিরসন হয়নি। 

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি জাতিও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিতে তাদের আভিজাত্যে লেগেছে, বাঙালি তাদের শাসন করবে এই বিষয়টি তাদের কৌলীন্যের অহংবোধকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। শুধু শাসন করার প্রেষণায় তাড়িত হয়ে তারা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, ২ লাখ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছে। 

ইন্ডিয়া টুডের জরিপকৃত বিশ্লেষণ বলছে, প্রতি ১৫ মিনিটে ভারতে দলিতদের বিরুদ্ধে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয়। ভৌগোলিক কারণ, জলবায়ুর প্রভাব এবং জিনের ভিন্নতার কারণে এক এলাকার মানুষের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষের শারীরিক ও মনস্তত্ত্ব গঠনে পার্থক্য রয়েছে। 

এই পার্থক্যকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে বর্তমান পৃথিবীতে বিরাজমান ৪২০০টি ধর্ম, এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোককে কখনোই আপন মনে করে না। ধর্মের কারণে এই পৃথিবীতে যত লোক মারা গেছে, আর কোনো একক কারণ তত লোক মারা যায়নি। মানবজাতির এত বিভেদ পৃথিবীটাকে অস্থির করে রেখেছে-মুক্তি চাই।

সাবেক নির্বাহী পরিচালক

বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //