জিসকা বিবি মোটি

শিরোনামটি হিন্দি ‘লা ওয়ারিশ’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে গীত গানের একটি লাইনের অংশবিশেষ। মজার গানটিতে যার স্ত্রী মোটা তার নানা সুবিধার কথা তুলে ধরা হলেও বাস্তবতায় সব ক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। যেমন অর্থনীতিতে ‘পৃথুলা মূল্যস্ফীতি’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ভজকট অবস্থার’ সৃষ্টি করে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি বিশ্বজুড়ে এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অন্যতম সংবেদনশীল স্থান দখল করে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছেন। মধ্যবিত্তও কষ্টার্জিত সঞ্চয় ভেঙে এই অবস্থা সামাল দিতে পারছে না। এই অবস্থায় মোটা মিয়া-বিবি উভয়ের ক্ষেত্রেই বর্তমান সময় সুবিধাজনক বা অনুকূল নয়।

গত ১১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১২ সালের মার্চ মাসে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি বা বাজারে পণ্য ও সেবার দর বেড়ে যাওয়ার বার্ষিক হার প্রকাশ করেছে।

কোনো নির্দিষ্ট মাসে বাজারে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যসূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কতটুকু বাড়ল, তার শতকরা হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি বলে। বিবিএসের আগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে এর আগে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয় গত বছরের আগস্ট মাসে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। 

অবশ্য পরের মাসগুলোতে সামান্য কমলেও তা ৯ শতাংশের আশপাশে ছিল। গত এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ এবং মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিবিএস বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে। গত জুন থেকে সমাপ্ত মে মাস পর্যন্ত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে। এ হার সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক ওপরে। চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

আইএমএফের পরামর্শে এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ২০২১-২২ বছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়েছে। এর আগে পর্যন্ত ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে এ হিসাব করা হতো। নতুন পদ্ধতিতে পণ্য এবং সেবার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা মূল্যসূচকে ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এত দিন ৪২২টি পণ্যের বাজারদর হিসাব করা হতো। নতুন হিসাবে মদ, সিগারেট, বেভারেজ ও মাদকদ্রব্য, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবারের ইন্টারনেটের খরচ, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে খাবারের খরচসহ আরও বেশ কয়েকটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যোগাযোগ খাতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ই-মেইলে ইন্টারনেটের ব্যবহারও এর আওতায় আসে।

বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল মে মাসে খাদ্যপণ্যের চেয়ে খাদ্যবহিভর্‚ত পণ্যে মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক বেশি। গত মার্চ থেকেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামের চেয়ে শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। মে মাসে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ, শহরে যা ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও গত মার্চ থেকেই পরিবর্তন আসে। আগের মাসগুলোতে শহরের চেয়ে গ্রামের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল।

বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি সেবার ক্ষেত্রেও ভোক্তা ব্যয় অনেক বেড়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাসা ভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যস্ফীতির গড় মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ মে পর্যন্ত গত এক বছরে বেড়েছে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে অর্থাৎ চিকিৎসা বাবদ ৮ দশমিক ৮৯ এবং যাতায়াত বা পরিবহনে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধের অভিঘাতের মধ্যেই বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশ কিংবা ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। 

থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি গত বছরের জুনের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে গত এপ্রিলে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতিও ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। অর্থাৎ উপযুক্ত পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি শুধু নিয়ন্ত্রণ নয় সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাও সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারতও মুন্সিয়ানার পরিচয় রাখছে।

বাংলাদেশে উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ঠিক; তবে সে হারে বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়। বিবিএসের প্রতিবেদনের মজুরি সূচক অংশে দেখা যায়, মে মাসে মজুরি মূল্যসূচক ভোক্তা মূল্যসূচকের চেয়ে অনেক কম। মূল্যস্ফীতি যেখানে বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সেখানে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। মজুরির এ গড় বৃদ্ধির চেয়ে শিল্প এবং নির্মাণ খাতে মজুরি আরও অনেক কম। 

বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও। তবে তিনি বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসার যে লক্ষ্যের কথা বলেছেন, সেটি কীভাবে অর্জন হবে, সেই ব্যাখ্যা দেননি। পরিকল্পনা মন্ত্রীর কাছে সেই ব্যাখ্যা আছে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, “বর্তমানে ৯ শতাংশের কাছাকাছি থেকে ৬ শতাংশে নিয়ে আসা, এটা অসম্ভব না, তবে খুব কঠিন হবে।” যদিও উন্নয়নশীল দেশে মূল্যস্ফীতি থাকবেই মন্তব্য করেন তিনি।

তুরস্ক এক যুগেরও অধিক সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির গ্যাঁড়াকলে আটকে ছিল। কিন্তু তখন বৈশ্বিক পরিস্থিতি এমন প্রতিকূলে ছিল না। ফলে তাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু তুরষ্কের মূল্যস্ফীতির অক্টোপাস চলতি শতকের শুরুতেও অর্থনীতির ছাত্রদের গবেষণায় আকর্ষণের বিষয় ছিল। সেখানেও আমাদের দেশের মতো ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ তত্ত্ব ছিল যা নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, “আপনি যদি মূল্যস্ফীতি না চান, তাহলে কোনো নতুন বিনিয়োগ নেই, সব কিছু নিয়ন্ত্রণে এবং কোনো প্রবৃদ্ধিও নেই। আপনি যদি প্রবৃদ্ধি করতে চান, অর্থনীতির আকার বাড়াতে চান, আপনি বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ান, তাহলে সেটা মূল্যস্ফীতির দিকে নিয়ে যাবে।” রপ্তানি বাড়ানো, আমদানি কমানোর পাশাপাশি বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি মৌলিক পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা বাজারে পণ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে এই কাজটা করতে পারি। এতে কিছুটা সময় লাগবে।” 

একথা বলা অমূলক হবে না যে মূল্যস্ফীতি সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে আড়াল করে দিচ্ছে। অতএব, এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রত্যাশিত।

রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সরকারের ঋণ কমাতে হবে। বিশেষত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আয়করের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সংকোচন করার বিকল্প নেই। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত অনুদানের অর্থ দীর্ঘদিন ধরে অপব্যয় করছে। যেমন ওই অর্থ থেকে অবসরপ্রাপ্ত আমলা পরিচালকদের ৩/৪ লাখ টাকা মাসিক বেতন, ভাতা, গাড়ি সুবিধা ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে, এসব অবিলম্বে বন্ধ করে অর্থ সাশ্রয় করতে হবে। 

পণ্য মূল্য নিয়ে সিন্ডিকেট সৃষ্টির সকল উদ্যোগ কঠোর হাতে দমন করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আপাতত মেগা প্রকল্প ও উচ্চ মূল্যের বিদেশি ঋণের রাস টেনে ধরার বিকল্প নেই।

কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //