জ্বালানি সংকট নিরসনে প্রয়োজন জ্বালানি ন্যায়বিচার

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে জ্বালানি ন্যায়বিচার নীতি গ্রহণ ও প্রতিপালন গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিশ্বই এখন কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে জ্বালানি খাতে একটি বৈশ্বিক সংকট প্রত্যক্ষ করছে।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ২০২০ সালের এপ্রিলের তুলনায় বর্তমানে আটগুণ ও অপরিশোধিত তেল প্রায় পাঁচগুণ বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও মনে করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ তার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অতীত ইতিহাসকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। কারণ দেশে গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে দ্রুত অগ্রগতির ফলে এক পর্যায়ে প্রায় ১০০ শতাংশ চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জিত হয়েছিল। 

ক্ষমতাসীন সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর গত প্রায় এক যুগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ এবং সঞ্চালন বাড়ানোর ওপর অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অধিক মনোনিবেশ করেছিল। এমনকি এখনো বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু ক্রমাগত বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য টেকসই উৎসকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় এখন সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলস্বরূপ সাধারণ একটি গ্রিড ত্রুটি বা প্রযুক্তিগত ত্রæটির কারণে পূর্বে স্বল্প সময়ের জন্য যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো তা এখন জ্বালানি সংকটের লক্ষণে রূপান্তর হয়েছে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রধানত গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। দেশে বর্তমান গ্যাসের মজুদ একই সঙ্গে শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে আমাদের বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে কয়লা, তেল ও গ্যাস আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তবে একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, জীবাশ্ম জ্বালানির আন্তর্জাতিক মজুদও অফুরন্ত নয়। এর দাম এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের সঙ্গে বৈশ্বিক শক্তির খেলা ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও কয়লার বর্তমান ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটকে অনিবার্য করে তুলেছে। 

বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান নামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিল; যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে জীবাশ্মের উপর গুরুত্বারোপ করে ৩৫ শতাংশ গ্যাস এবং ৩৫ শতাংশ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০২২ সালে প্রস্তুতকৃত খসড়া মাস্টার প্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে পাশ কাটিয়ে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০২৬ সাল নাগাদ দেশীয় গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে ৭০ শতাংশ আমদানিনির্ভর গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে; যার ইঙ্গিত বর্তমান সংকট থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। 

অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব কমাতে প্রাকৃতিক জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ শীঘ্রই জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিক, দ্রুত জ্বালানি বিচার নীতি প্রতিষ্ঠা ও সময়োপযোগী এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বড় রকমের জ্বালানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। 

পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জ্বালানি বিচার নীতি অনুসরণ না করে চলতি বছর ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান বিষয়ক একটি খসড়া তৈরি করেছে; যা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যদিও এটি এখন স্পষ্টত যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার আরও অস্থিতিশীল থাকবে। উক্ত খসড়ায় নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, অভ্যন্তরীণ গ্যাস সম্পদ অন্বেষণের প্রয়োজন, ব্যয়বহুল তেল-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে বন্ধ করা এবং পাওয়ার সেক্টরে সিস্টেম লস কমানোর জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা নেই!

বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিপর্যয় থেকে উত্তরণ এবং জ্বালানি আমদানি কমাতে ক্রমান্বয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পর্যাপ্ত উৎস ও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে; যা দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান ও টেকসই করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু, জোয়ার-ভাটা, হাইড্রোলজিক্যাল, সোলার থার্মাল, সমুদ্র তরঙ্গ এবং বঙ্গোপসাগরের অসীম শক্তি পরিস্থিতি সামাল দিতে এই মুহূর্তে বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করা উচিত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞগণ মোটামুটিভাবে অনুমান করেছেন যে বাংলাদেশের বায়ু এবং সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা যথাক্রমে ৬০,০০০ মেগাওয়াট এবং ৩৫,০০০ মেগাওয়াট। অধিকন্তু একটি বায়ু বা সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য। এছাড়াও আমাদের দেশের বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা শুধু কক্সবাজার বা অন্যান্য উপক‚লীয় এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়।

বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পরে বায়ু শক্তির সরবরাহ ভালো। বায়ু শক্তি থেকে ৮০ মিটার উচ্চতায় ৩৩,০০০ মেগাওয়াট তড়িৎ উৎপাদন করা সম্ভব; আর উচ্চতা ১২০ মিটারে উন্নীত করতে পারলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। উপরন্তু বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিভিত্তিক দেশে শুধু কৃষি ফসলের অবশিষ্টাংশ, পশু বর্জ্য ও স্থানীয় বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োমাস ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। জ্বালানির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সুপ্রশিক্ষিত মানব সম্পদ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের উচিত বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবিলায় কিছু আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যার মধ্যে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি ন্যায়বিচারের নীতির সংযোজন ও অনুশীলন, উচ্চ হারে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্বল্পমূল্যে স্থানীয় গ্যাস কেনার উপর জোরারোপ করা। বিদেশি কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাপেক্সকে শক্তিশালী করার এখনই সর্বোত্তম সময়। কারণ জ্বালানি খাতে নীতিনির্ধারকদের আগের একই ভুলের মূল্য দেশের নাগরিকগণ পুনরায় আর দিতে পারবে না।

সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //