পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন সহিংস হয়ে উঠলো কেন?

শনিবার (৮ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যার ফলাফল জানা যাবে ১১ জুলাই। পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের অন্যান্য নির্বাচনের তুলনা করলে এর গুরুত্ব কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশি। এটা এমন একটা নির্বাচন, যার মধ্যে দিয়ে গ্রামবাংলা কোনদিকে যাচ্ছে তার একটা ছবি পরিস্কার হয়ে যায়। 

গ্রামবাংলার ছবিটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে যতই শহর নিয়ে আমরা চেঁচামেচি করি না কেনো, আজও পশ্চিমবাংলার ভোটের নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা সংখ্যাগরিষ্ট অংশ কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা। যে ভোটের মাধ্যমে আমাদের দেশের অনেক কিছুর মিমাংসা হয়, মিডিয়ার ভাষায় ভোট ব্যাংক বলতে যা বোঝায়, তার বড় অংশই কিন্তু গ্রামেই বসবাস করে। ফলে শুধু নির্বাচনের সময়ই গ্রামবাংলার দিকে তাকিয়ে থাকে বললে হয়তো ভুল হবে। সারাবছরই পশ্চিমবাংলার মানুষজন ওদিকে খেয়াল রাখে যে তাদের রায় কোনদিকে যাচ্ছে।

বাঙ্গালী মুসলমানদের ৩০ শতাংশই কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা। খেয়াল করলে দেখা যাবে তারা কিন্তু শহরে থাকেন না। ৪৭ পরবর্তী দেশভাগের পরিণতিতে এই ঘটনাটা হয়েছে। গ্রামের বাইরে বাঙ্গালী মুসলমানকে কিন্তু খুঁজে পাবেন না। অনেকেই কাজের প্রয়োজনে হয়তো শহরে আসেন। কিন্তু কাজ শেষে তারা আবার ফিরে যান তার সেই শেকড় গ্রামেই। গ্রামের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গা থেকে যে, বোঝা যায় মুসলিম ভোট কোনদিকে যাচ্ছে। গ্রামের যে গরীব মানুষের দলিত অংশ আছে, গরীব হিন্দু আছে বাউড়ি, বাগদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন আছে, যারা বাঁশের কাজ, তাঁতের কাজ এই রকম নানা ধরনের কাজ করেন তাদের ভোট কোনদিকে যাচ্ছে। তো এইসব আজ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্ধারণ হয়ে যাবে। 

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের অন্যতম একটা কৃতিত্ব অবশ্যই আমি বামফ্রন্ট সরকারকে বলব। তারা যখন ’৭৭ সালে ক্ষমতায় আসে এরপর তারা বেশ কিছু যুগান্তকারী ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে- পঞ্চায়েতের মধ্য থেকে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ, নারীকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসা, অন্যান্য গরীব মানুষদেরকে কেবল রাজনীতি সচেতন করাই নয়, রাজনীতির যে নীতি নির্ধারণ বা ক্ষমতার ক্ষেত্রে যে নীতি নির্ধারণ সে ব্যাপারে যাতে ভূমিকা নিতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করা। ফলে দেখা গেল ৭৭/৭৮ সালের পঞ্চায়েতের ফলে একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তারা ভূমি সংস্কারের কথা বলেছে, প্রান্তিক বা ভূমিহীন কৃষকদের তারা জমি দিয়েছে, খাস জমি উদ্ধার করেছে এবং সেটা তারা গরীব মানুষের মধ্যে বন্টন করেছে। খেত মজুরদের মজুরী বৃদ্ধি করেছে, বর্গাদারের জমি রেকর্ড করেছে, আর  এভাবে কৃষকদের একটা বিরাট অংশ দীর্ঘদিন ধরে বামদের পেছনে ছিল এবং তাদের সমর্থন করেছে। 

তবে যা হযেছে, দীর্ঘদিন পঞ্চায়েতে থাকার কারণে বামফ্রন্ট্রের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাদের যে মূল শ্রেণীভিত্তিক অংশ- গরীব মুসলমান, শ্রমজীবি, কৃষক সমাজ তারা ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলো। সে জায়গা দখল করলো গ্রামের মধ্যবিত্ত। ততদিনে শহরেও বেশ কিছু কাজ হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মাইনে বেড়েছে, তাদেরও কোনো না কোনোভাবে গ্রামের সাথে যোগাযোগ ছিল। গ্রামের যারা অবস্থাসম্পন্ন চাষী,  এবং যারা একদা জমিদার ছিলেন তারা কিন্তু ধীরে ধীরে কংগ্রেসের প্রতি তাদের পুরনো আনুগত্য ত্যাগ করে সুবিধার রাজনীতি করার জন্য আদর্শকে ত্যাগ করে লাল পতাকার নীচে আশ্রয় নিতে লাগলো এবং বিস্ময়কর হলো আগে যে গরীব কৃষক এবং ধনী শ্রেনীর মধ্যেকার পরস্পর বিরোধ এবং সংঘাত ছিল সেটা ধীরে ধীরে বামফ্রন্টের চালিকা শক্তি হলো। ফলে গরীব শ্রেণী দূরে সরে যেতে লাগলো, তারা বঞ্চিত হতে থাকলো এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হতে থাকলো। এই হতাশার একটি প্রতিক্রিয়াই কিন্তু ৩৪ বছর পরে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পেছনে খুব বড় একটা ভূমিকা রেখেছিল। ততদিনে কিন্তু কৃষি উৎপাদন কিছুটা হলেও কমেছে, মুক্ত অর্থনীতির কু প্রভাব গ্রামীন জনপদে পড়তে শুরু করেছে। কৃষির সাবেক পদ্ধতিগুলো বাতিল হয়ে গেলো, হালের বলদ বাতিল হলো, গরু গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল, তার জায়গায় ট্রাক্টর ঢুকতে লাগলো, প্রযুক্তি ঢুকতে লাগলো , বহুজাতিক কোম্পানি, সার  ব্যবহার শুরু হলো। এতে উৎপাদন কিছুটা বাড়লো বটে, কিন্তু চাষের যে ক্ষমতা তা কৃষকের হাতের বাইরে চলে যেতে শুরু করলো। ফলে কৃষকরাও চেষ্টা করতে লাগলো তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে চাকরির ব্যবস্থা করার দিকে। কিন্তু সেভাবে তো শিল্প গড়ে ওঠেনি। ফলে হতাশা তাদের গ্রাস করতে শুরু করলো। এই হতাশাই কিন্তু একটা পরিবর্তনের অনুঘোটকের কাজ শুরু করলো। মমতা বন্দোপাধ্যায় আসার পেছনে এটা একটা বড় কারণ বলা যেতে পারে।

তৃণমূল আসার পরে ধীরে ধীরে দেখা গেল যে পরিবর্তন কিন্তু উল্টো হলো। এর আমি ২টা কারণ বললো। এক হলো পুরনো যে বর্গাদারী ব্যবস্থা, অনেক জায়গায় তাদের রেকর্ড রয়েছিল তৃণমূল তাদের সরিযে দিয়ে পুরনো যে ধণী কৃষক ছিল তাদের আবার নামে বেনামে সেসব পাইযে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আর সবচে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো মমতার দুর্নীতি, যা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরলেই দেখা যায়। ব্যাপক দুর্নীতি, সর্বত্রই একটা সংক্রমিত চেহারা নিয়েছে। তবে আমি বলবো না যে সেই দুর্নীতির কারণেই আজ মমতার পতন ঘটে যাবে। এটা রাজনীতির কথা। তবে আমি বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি তার যে কিছু সামাজিক কাজ, তাতে বেশ কিছু মানুষ উপকৃত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের মধ্যে এখনো মমতার  প্রতি একটা টান বা আবেগ রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি যে বিরোধীদের কথা শুনব, তাদের মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, বিরোধী স্বরকে আমরা খানিকটা জায়গা দেব, মমতা ব্যানার্জী তার ধারেকাছেও নাই। শহরে তো নয় বটেই, এমনকি গ্রামেও বিরোধী স্বরকে কিছুমাত্র সহ্য করার যে ধৈর্য তা তার নেতা কর্মী বা দলের লোকজনের কিছুমাত্র আছে বরল আমার মনে হয়নি।

এইবার পঞ্চায়েত উপলক্ষ তো পশ্চিমবঙ্গে রক্তগঙ্গা বযে যাচ্ছে। অনেকে বলেন ২২ জন মারা গেছে, ২৩ জন মারা গেছে। কিন্তু যদি ৩ জনও মারা যায় লক্ষ করলে দেখা যাবে যে মারা যাচ্ছে কিন্তু গরীব মানুষগুলো। সে তৃণমূল বা বিরোধীদল যাদের কর্মীই হোক। আপনারা যদি ১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখেন, সেখানে কিন্তু ভোট দেয়ার কোনো জায়গাই তৈরি হয়নি। এবার কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণেই সম্ভবত সিপিএমএর বেশ কিছু তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বিজেপির কথা ফুলয়ে ফাঁপিয়ে বলা হয় বটে। কিন্তু গ্রাম বাংলায় বিজেপির খুব একটা অস্তিত্ব আসলে নেই। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় নানান স্বার্থের কারণে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয় বিজেপি এই করেছে, সেই করেছে। কিছু বিক্ষিপ্ত, সুবিধাবাদী আরএসএসএর কিছু মানুষ হয়তো আছে। কিন্তু আমি মনে করি এবারের পঞ্চায়েতে মূলত সংঘাতটা হয়েছে বাম কংগ্রেস এবং নতুন যে দলটি গড়ে উঠেছিল, আইএসএফ- দক্ষিণ এবং পশ্চিম পরগনায় তারা যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এবং এই প্রতিরোধের কারণেই কিন্তু অনেক জায়গাতে স্বতস্ফূর্তভাবেই সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ভোট দিতে দেবে না, দৌরাত্ম হবে, গ্রামবাংলার ছবিটা তো এরকমই দাঁড়িয়েছে! যে লোকটির পাকা বাড়ি আছে, সেই লোকটিই কিনা বাড়ির জন্য বরাদ্দ টাকা পেয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন  খাতের অর্থ চিহ্নিত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে বন্টন হয়েছে। এরকম অনেক অনিয়ম হয়েছে। আর এইসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে গরীব মানুষেরাই। ফলে এই সংঘাতে মারা যাচ্ছে তারাই।

সৌমিত্র দস্তিদার, তথ্যচিত্র নির্মাতা, কলকাতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //