অরক্ষিত নাগরিক তথ্য

তথ্য গোপন করা রাষ্ট্রের একটি অতি সাধারণ ধর্ম। অর্থাৎ রাষ্ট্র চায় নাগরিকরা কম তথ্য জানবে। আবার নাগরিকের সুরক্ষার জন্যই রাষ্ট্রকে অনেক তথ্য গোপন রাখতে হয়। কিন্তু অনেক সময় প্রয়োজনীয় তথ্যও নাগরিকরা পায় না। সেজন্য দেশে তথ্য অধিকার আইনও রয়েছে। কিন্তু সেই আইন সাধারণ নাগরিক এবং সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়ার পথ কতটা সহজ করেছে-সেটি তর্কসাপেক্ষ। 

কিন্তু সম্প্রতি যে খবরটি নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়ে যায় সেটি হলো-সরকারি ওয়েবসাইট থেকে লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস। খবরে বলা হয়, দেশের অনেক নাগরিকের নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল এবং জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটির গবেষক ভিক্টর মারকোপোলোসের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন সংবাদ মাধ্যম টেকক্রাঞ্চ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে একটি সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হয়েছে।

তবে কোন ওয়েবসাইট থেকে এসব তথ্য ফাঁস হয়েছে, নিরাপত্তার খাতিরে তারা সেটি উল্লেখ করেনি। মারকোপোলোসের বরাতে টেকক্রাঞ্চ বলেছে, গত ২৭ জুন হঠাৎ করেই তিনি প্রকাশিত তথ্যগুলো দেখতে পান। গুগলে সার্চ করার সময় প্রকাশ হওয়া তথ্যগুলো আপনাআপনিই হাজির হয়। 

এই খবর প্রকাশের পরপরই এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর জানান, নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সার্ভার সুরক্ষিত আছে এবং ইসির সার্ভার থেকে কোনো তথ্য ফাঁস হয়নি। তিনি বলেন, ইসির কাছ থেকে ১৭১টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সেবা নিয়ে থাকে। সার্ভারের তথ্যাবলির ওপর কোনো থ্রেট আসেনি। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ০৯ জুলাই ২০২৩)। আর তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী (আইসিটি) জুনাইদ আহমেদ দাবি করেছেন, সরকারি একটি সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে ‘লাখ লাখ’ মানুষের তথ্য ফাঁসের ঘটনাটি ঘটেছে কারিগরি দুর্বলতায়। কেউ ওয়েবসাইটটি হ্যাক করেনি। (প্রথম আলো, ০৯ জুলাই ২০২৩)।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাগরিকের তথ্য নানাভাবে থাকে এবং ব্যবহার করা হয়। যেমন-এখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে গেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। এর বাইরে অন্য আরও অনেক সেবা পেতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র, কর শনাক্তকরণ নম্বর, এমনকি নাগরিকতার সনদপত্রও লাগে। এই সব তথ্য গোপনীয়। অতএব যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার জন্য নাগরিকরা তথ্য প্রদান করেন, সেগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন দায়িত্ব, তেমনি সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র বা সরকারও নাগরিকের তথ্য গোপন রাখায় দায়বদ্ধ।

সুতরাং কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু লোকের গাফিলতি কিংবা সিস্টেমের দুর্বলতার কারণে যদি নাগরিকদের তথ্য অনাকাক্সিক্ষতভাবে ফাঁস হয়ে যায়; সেই দায় রাষ্ট্র বা সরকার এড়াতে পারে না। কেননা সরকার যে যুক্তিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে বা প্রয়োজনে অনেক তথ্য গোপন রাখে, এমনকি গণমাধ্যমকেও জানতে দেয় না, সেই একই যুক্তিতে প্রতিটি নাগরিকের তথ্য গোপন রাখাও তার দায়িত্ব। 

কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় যে এই গোপনীয়তা বজায় থাকে না। শুধু তাই নয়, মোবাইল ফোনে ব্যক্তিগত আলাপচারিতাও অনেক সময় ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁসের মধ্য দিয়ে। ২০১৫ সালে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপও ফাঁস হয়। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ফোনালাপও ফাঁস হয়। সেই তালিকায় পরে যুক্ত হন হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক।

১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছেNo one shall be subjected to arbitrary interference with his privacy, family, home or correspondence, nor to attacks upon his honor and reputation. Everyone has the right to the protection of the ” অর্থাৎ কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও যোগাযোগের ব্যাপারে খেয়ালখুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা যাবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।

সুতরাং নাগরিকের যে তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, সেটি জাতিসংঘের এই মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থি। কারও খারাপ উদ্দেশ্যে কিংবা সিস্টেমের দুর্বলতার জন্যও যদি এই ঘটনা ঘটে থাকে, সেটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। 

এটা ঠিক যে, ফোনালাপ ফাঁস অনেক সময় বড় কোনো ঘটনারও জন্ম দেয় বা বড় ধরনের অপরাধের হাত থেকে দেশকে বাঁচিয়ে দেয়। যশোরের এক এমপি স্থানীয় এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে পুলিশকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই ফোনালাপ ফাঁস না হলে এই অপরাধের খবরটি জানা যেত না। 

কিন্তু মুশকিল হলো শুধু ফোনালাপ নয়, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অডিও-ভিডিওসহ নানা তথ্য প্রকাশের ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন তথা ডিজিটাল দুনিয়া যত বেশি প্রসারিত হচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ইস্যুটি তত বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনে মানুষ এখন অফিসিয়াল বিষয়ের বাইরে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। কারণ সবার মনেই এই প্রশ্ন বা সংশয় কাজ করে যে, ফোনকলটি রেকর্ড হচ্ছে কি না বা কেউ আড়ি পেতে আছে কি না। এই আতঙ্কে অনেকে মোবাইল ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান না। অনেকেই মোবাইল ফোনের সাধারণ কলের বদলে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত সাইবার হামলার ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) চুরি হয়। পরে ফেরত পাওয়া যায় দেড় কোটি ডলার। এ ঘটনায় কারও শাস্তি হয়নি। এরপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তথ্যভাÐার থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন সংক্রান্ত প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের আবেদনের নথিপত্র গায়েব হয়ে যাওয়ার খবরও এসেছিল। ফলে এবারও যে প্রতিষ্ঠানের কারিগরি দুর্বলতা কিংবা দায়িত্বশীলদের গাফিলতির কারণে লাখ লাখ মানুষের তথ্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ল, তাদের শাস্তির আওতায় আনা এবং সুরক্ষাবলয় শক্তিশালী করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও বড় ঘটনা ঘটবে কি না, তা বলা যায় না। কারণ ছোট অপরাধগুলো বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পড়ে গেলে বড় অপরাধের জন্ম হয়। 

২০১৮ সালে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গত বছরের অক্টোবরে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে ঘোষণা করে তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তোলা দরকার।

ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারাবাহিকতায় এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা তথা ডিজিটাল দুনিয়ায় নাগরিকের তথ্য এবং নাগরিকরা কতটা নিরাপদ ও সুরক্ষিত, সেই প্রশ্নেরই সুরাহা করা যায়নি এখনো। 

সর্বোপরি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ফাঁস’ হওয়া তথ্যগুলো কতজন দেখেছেন; যারা দেখেছেন তারা এই তথ্য কাজে লাগিয়ে কী করতে পারবেন; তথ্যগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা গোপনীয়, তার চেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান নাগরিকের তথ্য পাহারায় নিয়োজিত তারা নিজেরা কতটা সুরক্ষিত; তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং নাগরিকের প্রতি তাদের দায়বোধের মাত্রা কেমন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আরও অনেক প্রশ্ন সামনে আসবে যেগুলোর মীমাংসা করাও জরুরি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //