নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান ও কৌশল

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৬-৭ মাস বাকি। নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে, এটাই জনগণের কাম্য। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, পঁচাত্তরের পর থেকে নির্বাচন সামনে এলেই বয়কট কি বয়কট নয়, এমন প্রশ্ন সামনে আসে। 

এবারে দেশের দ্বিতীয় বড় দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে না নিলে নির্বাচন বয়কট করার কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই দুই দলের কৌশল ও অবস্থান দিয়েই আবর্তিত হয় বিধায় আসন্ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হবে কি না, তা বলা কঠিন। এ সুযোগে অনভিপ্রেতভাবে বিদেশিদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বয়কট আন্দোলন সফল হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন হয়েছিল এবং পরে ৪ মাসের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ বিএনপি প্রায় সব রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং তীব্র ও ব্যাপক গণআন্দোলন ছিল। গণরোষে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব ছিল না। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা ও তখনকার বাস্তবতায় আর্মিও ক্ষমতা নেওয়ার মতো অবস্থানে ছিল না। 

আর দুই বার বয়কট আন্দোলন তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি সফল হয় নাই। ১৯৮৬ সালে দুই জোটের যুগপৎ ও জামায়াতসহ বয়কট আন্দোলনের পরও নির্বাচন ও সংসদ কার্যক্রম চলেছে। ৪ বছর আন্দোলন করে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় সম্ভব হয়েছে। আর ২০০৬ সালে বয়কট আন্দোলনে আর্মি ও নিরপেক্ষ বলে সুপরিচিত সুশীল সমাজের ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের জরুরি আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। পরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার ভিত্তিতে আন্দোলনের কারণে সরকারের ‘মাইনাস টু ফরমুলা’ ও ‘কিংস পার্টি’ গঠন পরিকল্পনা অর্থাৎ হাসিনা-খালেদাকে নির্বাসনে পাঠানো এবং ড. ইউনূসের পার্টি গড়ার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়। এর জন্য দুই বছর সময় লেগেছে।

উল্লিখিত নির্বাচনগুলোর ঘটনা পর্যালোচনায় দুটো দিক সুস্পষ্ট। প্রথমত সরকারকে আন্দোলন দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দাবি মানিয়ে নেওয়া সহজ কাজ নয়। দ্বিতীয়ত বিদেশিরা নয়, গণআন্দোলনই মূলত ও প্রধানত রাজনৈতিক গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তৃতীয়ত এ ধরনের আন্দোলন সংবিধান ধারা ব্যাহত করে এবং পরে আবার একই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ গণবিচ্ছিন্ন এমনটা কেউ বলবে না। সরকার সংহত রয়েছে। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট অটুট রয়েছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে এবং থাকবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ভালো কিছু হবে এমনটা জনগণ মনে করছে না। 

এদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হতে ৩-৪ মাস সময় বাকি থাকলেও কোনো গণআন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিগত সময়ে বিএনপির সঙ্গী ছিল জামায়াতসহ ২০টি দল, তা এখন ভেঙে গেছে। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে এমনটা প্রচার হলেও ওই দল শেষ পর্যন্ত কী ধরনের অবস্থান নেবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। বিগত নির্বাচনের আগে নামি-দামি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ড. কামালের নেতৃত্বে গঠিত জোটকে সঙ্গী করে বিএনপি অগ্রসর হতে চেয়েছিল, নির্বাচন উপলক্ষে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ওই ঐক্য এখন আর নেই। 

ইতোমধ্যে জানা গেছে, নাগরিক ঐক্য (মাহমুদুর রহমান মান্না), গণসংহতি পরিষদ (জোনায়েদ সাকি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি (সাইফুল হক) প্রভৃতি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, কল্যাণ পার্টি (ইবরাহীম), জাতীয় পার্টি (জাফর) প্রভৃতি দল নিয়ে গঠিত ১২ দল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য প্রভৃতি ৩৬টি দল বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছে । এদের নিয়ে বিএনপি বয়কটের ধারায় থেকে আন্দোলনের চেষ্টা করবে। 

বিএনপির নেতারাই বলছেন, আগস্ট পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে। যদি সফল না হয়, তবে শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে বিএনপির ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ বা ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বাড়বে। এদিকে যতই সময় যাবে নির্বাচনের মাঠে বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি সুযোগ নিতে থাকবে। ১৪ দলকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি ফাঁকা মাঠে নির্বাচনে নেমে যাবে। এতে হিতে বিপরীত ফল পেতে পারে বিএনপি।

এই অবস্থা ক্রমে সুস্পষ্ট হতে থাকলেও এবং কতক সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল নিয়ে আন্দোলনে নামলেও বিএনপি আজ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দিতে পারেনি। বিগত মাসে জানা গিয়েছিল, বিএনপির নীতিনির্ধারণী সভায় কখন রূপরেখা দেওয়া হবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। 

তদুপরি নির্বাচনকালীন সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ হবে কি না, সংবিধান সংশোধন না করেও নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব কি না, আদালতের রায়ের আলোকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর দুই মেয়াদ কার্যকর করা যায় কিনা, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছে। 

এ মাসের প্রথম সপ্তাহে খবরে জানা গিয়েছিল, খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে বিএনপি। তাতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো প্রধান উপদেষ্টা সাবেক প্রধান বিচারপতি নয়, হবেন বিশিষ্ট নাগরিক। কেন এই পরিবর্তনে বিএনপি যাবে এর কারণসমূহ সুস্পষ্ট। প্রথমত বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়ায় বিধান করে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিল বিএনপিই। দ্বিতীয়ত বিএনপি মনে করে এখন যদি ওই ফরমুলায় যাওয়া যায়, তবে একান্তভাবেই লাভবান হবে আওয়ামী লীগ। প্রশ্ন হলো, বিশিষ্ট নাগরিক ঠিক করবে কে?

যদি বিএনপি আন্দোলনে বিজয়ী হয়, তবে পরাজিত আওয়ামী লীগ তখন সংবিধান সংশোধন করতে যাবে কেন? যদি অবৈধ কোনো শক্তি এসে সংবিধান স্থগিতও করে, তবে আওয়ামী লীগ ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ ঠিক করার প্রক্রিয়ায় যাবে কেন? আওয়ামী লীগ তখন আন্দোলনে যাবে। সেই শক্তি দলটির রয়েছে। দলটি তখন সংলাপ-নির্বাচন বয়কট করবে। তখন তো দেশ আরও অনিশ্চিত অবস্থায় পড়বে। 

এদিকে সংলাপের প্রশ্নেও বিএনপি অনড়। কখনো বলছে সরকার পদত্যাগ করলে আবার কখনো বলছে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিলে সংলাপে যাবে। এককথায় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ও সংলাপ প্রশ্নে বিএনপি দিকনির্দেশহীন। সর্বোপরি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করবে, তা নিয়েও মাঠে বক্তব্য রাখছে না। কেবল রূপরেখাহীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ইস্যু করতে চাইছে। 

বাস্তবে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ছাড়া জাতীয় ঐকমত্যের সরকার সোনার পাথর বাটি সম। তদুপরি জামায়াত থাকবে কি না অনিশ্চিত। বাম ফ্রন্টও বিএনপির সঙ্গে থাকবে বলে মনে হয় না। যদি ধরে নেওয়া যায় বিএনপি বিজয়ী হবে, তবে প্রশ্ন উঠবে ‘ক্ষমতার বিকল্প’ কেন্দ্র হাওয়া ভবন ও খোয়াব ভবন খ্যাত নির্বাসিত তারেক রহমানের নেতৃত্বে কোন কোন দল ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ কাজে বিএনপির সঙ্গে যাবে। 

বিএনপি সংলাপ ‘না’ করে কেবল রূপরেখাহীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারকে ইস্যু করে অগ্রসর হতে চাইছে। প্রকৃত বিচারে যে দল ১৫ বছর বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো কর্মসূচিই ঠিক করতে পারে না, কোনো সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীবাহিনীকে জীবনবাজি রেখে আন্দোলনে নামাতে পারে না, সেই দল অর্ধ বছরে জনগণকে মাঠে নামাতে পারবে, এমনটা মনে করা কষ্টকর। 

 বিদেশিরা নির্বাচন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যে তৎপরতা করে যাচ্ছে, তা বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রথমত বিদেশিদের তৎপরতাকে দেশবাসী বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জের হিসেবে দেখছে। দ্বিতীয়ত বিদেশিরা সরকারকে সংবিধান পরিবর্তন করতে বলবে অর্থাৎ এতটা অগ্রাসী হবে বলে মনে হয় না। ধারণা করা যায়, বড়জোর শর্তহীন সংলাপের অবস্থান নেবে। 

ইতোমধ্যে প্রকাশিত খবরাখবরে জানা যাচ্ছে, বিএনপির সাবেক চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংলাপ ও নির্বাচনের পক্ষে এবং বর্তমান চেয়ারপারসন তারেক জিয়া সংলাপ-নির্বাচনের বিপক্ষে। 

সরল ও স্বাভাবিক বিবেচনায়ই বলা যায়, নির্বাচন যত সামনে আসতে থাকবে বিএনপির মধ্যে বয়কট, রূপরেখা, সংলাপ নিয়ে মতদ্বৈধতা ও অস্থিরতা বাড়তে থাকবে। আগে থেকেই বিএনপির মধ্যে রয়েছে নবীন-প্রবীণ মতানৈক্য, যা পুনরায় দানা বেঁধে উঠতে পারে। এর মধ্যে মা ও ছেলের মধ্যে যদি মতভেদ থাকে, তবে তা বিএনপির জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে পারে।

 বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলনকে অগ্রসর করবে। বাস্তবে ২০১৪ সালে আগুন সন্ত্রাস, জনগণের মনোভাব ও বর্তমানে আমেরিকার ভিসা নীতি তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় বিএনপি সংলাপ-নির্বাচনে গেলে নির্বাচনী চালচিত্র হবে একরকম আর না গেলে হবে অন্যরকম। আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বদ্বিতার মধ্যে পড়বে নাকি ফাঁকা মাঠে গোল দেবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক এর উত্তর দিতে পারবে না।

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //