দেশের প্রধান সমস্যা কি অবাধ নির্বাচন

এ মুহূর্তে জনগণের সামনে দেশের এমন একটা চিত্র রয়েছে যাতে মনে হবে বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা আগামী জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় সে জন্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রতিনিধিরা দফায় দফায় সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, করছেনও। কিন্তু আসলেই কি দেশের এক নম্বর সমস্যা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন? 

এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দৃশ্যত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই হয়নি। ২০০৬, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে নির্বাচনের উদাহরণ তৈরি হয়েছে তা রীতিমতো প্রহসন। সংসদে বিরোধী দল থাকার বিধান আছে বলে কিছু সিট ছেড়ে ‘গৃহপালিত’ বানানো হয়েছে। এবারও সেসবের পুনরাবৃত্তিরই শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। 

দেশে এ মুহূর্তে প্রধান সংকট মুদ্রাস্ফীতিজনিত সীমাহীন পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, সর্বস্তরে মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা, অবাধে বিদেশে টাকা পাচারের কারণে সৃষ্ট তারল্য সংকটের দায় মেটানোর জন্য জনগণের ঘাড়ে ঋণের বোঝা, বাজার সিন্ডিকেটের কাছে সরকার জিম্মি হওয়ায় লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, জনগণের ঘাড় মটকে ভর্তুকি আদায় করা, বিশ্বজুড়ে সাহায্য-সহযোগিতা কমে যাওয়া, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে শহর থেকে একেবারে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও। সেই সঙ্গে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এর মতো কালাকানুন।

পিডিবির তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। যদিও ওই দরপত্রে একটিমাত্র কোম্পানি অংশ নেয়। ফলে তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। কুইক রেন্টাল ক্যাপাসিটি চার্জ নামে কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার কোম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। 

পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় প্রায় ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অলমোস্ট তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে। যদিও এ সময় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো বছর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। অথচ বসিয়ে রেখেই প্রতিবছরই ক্যাপাসিটি চার্জের পুরোটা পরিশোধ করা হয়। এই টাকার জোগান কে দিয়েছে? দিয়েছে জনগণ। জনগণের ওপর চড়া হারে ট্যাক্স বসিয়ে, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করে টাকার জোগান দিয়েছে।

ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারের ওপর চাপ এসেছে সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এই একই দাবিতে বিএনপিসহ অন্যান্য প্রধান বিরোধীদলও সোচ্চার হচ্ছে। তাদের দাবি দলীয় সরকারের অধীনে, অর্থাৎ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল। যদিও এক সময় এই আওয়ামী লীগই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করবে না এবং হতে দেবে না’ বলেছিল। যা হোক, বল এখন মাঝ মাঠে। ১২ জুলাইয়ের পাল্টাপাল্টি সমাবেশে বিএনপি একদফা- (শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন) দাবি দিয়েছে। আওয়ামী লীগও তেমনি একদফা- (শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে) ঘোষণা করেছে।

ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর করছে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি দল ১১ জুলাই ঢাকায় এসেছে। তাদের এই সফরের অন্যতম আলোচ্য বিষয় নির্বাচন। তারও আগে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতার বাজে রেকর্ডের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আরও পরে বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। এই সবই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে।

এতকিছুর পরও কি মনে হয় দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে? সরকার ইতোমধ্যে দুটি ‘ছোট্ট’ চাল চেলে দিয়েছে। ২০২২ সালে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিটের শুনানির পর বিধানটি আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ বাতিলের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে। হাইকোর্টের সেই রায় ২০২২-এর সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত করেছিল আপিল বিভাগ। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি আইনের একটি ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে তার দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের হলে আদালতে চার্জশিট গ্রহণের আগে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না এমন বিধান ছিল। যদি গ্রেপ্তার করতে হয় তাহলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। সেই স্থাগিতাদেশের পরে রায়টি অকার্যকর হয়ে যায়।

এবার আবারও নতুন করে সেই আগের নিয়ম- ‘স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে করা ফৌজদারি মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করার আগে তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।’ 

এমন বিধান রেখে সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল-২০২৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। জানা কথা, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে যে কোনো বিল যে কোনো সময় সরকার উত্থাপন এবং পাস করিয়ে নিতে পারে। যদিও নামকাওয়াস্তে বিরোধী দলের সদস্যরা এই আইন পাসের তীব্র বিরোধিতা করেন, এবং তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এতে করে আগামী নির্বাচনে যে সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবে তারা নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকারি প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন করলে, প্রকাশ্যে ‘দলীয় মস্তানের’ ভূমিকা নিলে, কিংবা নির্বাচনকালীন আইন-কানুন ভঙ্গ করলেও কোনো বিবেকবান নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগকারী তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না! 

তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? নির্বাচন কমিশন থেকে পোলিং এজেন্ট হয়ে ভোট গণনা এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সকল ক্ষমতা প্রয়োগকারী লোকজন তাদের নির্বাহী ক্ষমতাবলে ‘যা খুশি তাই’ করতে পারবেন। তার কারণে তাদেরকে অপরাধী বলা যাবে না, গ্রেপ্তার তো করা যাবেই না। তাই যদি হয় তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল, কানাডা ও ইউরোপ-এশিয়ার অন্যান্য দাতা দেশের পর্যবেক্ষকরা কী করতে পারবেন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //