দক্ষিণে করকরে বিয়ে

করকরে শব্দের আভিধানিক অর্থ নতুন বা তরতাজা, আনকোরা, করকর ধ্বনি উৎপন্ন করে এমন। আর এই লেখায় ‘করকরে’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘কর থেকে কর উৎপন্ন হয় যেখানে’ বোঝাতে। অর্থাৎ বিবাহের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে প্রদেয় ‘কর’ এবং এই করের ওপর ‘মূল্য সংযোজন কর’ বা ভ্যাট বোঝাতে।

সম্প্রতি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সিটি কর্পোরেশন। কর্পোরেশনের আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬-এর ক্রমিক ১০.৪.১৫২.ক অনুসারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন অধিক্ষেত্রে প্রথম বিবাহ অথবা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিবাহের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা হারে ‘কর’ এবং উক্ত করের উপর ১৫% হারে ভ্যাট আদায় যোগ্য। আইন ও বিচার বিভাগের আওতাভুক্ত সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড/স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার/হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক/খ্রিষ্টান ম্যারেজ রেজিস্ট্রার/ স্পেশাল ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে কর্পোরেশনের রসিদ গ্রহণের মাধ্যমে উক্ত ‘কর’ পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

অর্থাৎ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিয়ে করতে গেলে ‘ডাবল কর’ (বিয়ের কর+ ভ্যাট) প্রদান করতে হবে। বিয়ে এখন খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এমনকি হতদরিদ্রের বিয়েও। সে বিবেচনায় এই কর তেমন বোঝাস্বরূপ মনে হওয়ার কথা নয়। কারণ রিকশা চেপে কাজি অফিসে যাতায়াতে এর চেয়ে বেশি খরচ হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে ২০১৬ সালের কর তফসিল নিয়ে। প্রথম বিয়েতে ‘কর’ বা স্ত্রীর মৃত্যুতে ‘কর’ যদি দিতে হয় তবে একাধিক বিয়েতে অর্থাৎ ২য়, ৩য় বিয়ে ইত্যাদিকে করের আওতাবহির্ভূত রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। ইসলাম ধর্মাবলম্বী পুরুষের ক্ষেত্রে ৪টি বিয়ে স্বীকৃত হলেও সে ক্ষেত্রে সবার প্রতি সমান আচরণ করতে সক্ষম ব্যক্তিই পরবর্তী বিয়ে করতে পারেন ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান পরিপালন করে। তাহলে কি সিটি কর্পোরেশন ধরে নিয়েছে এই এলাকায় বহু বিবাহ ধর্তব্য নয়?

বরং পরিবার, সন্তানসন্ততি সবার অবস্থা বিবেচনায় পরবর্তী সব বিয়েই করের আওতায় আনা সমীচীন। কারণ স্ত্রীর মৃত্যুতে বিয়ের ক্ষেত্রে ঠিকই কর আরোপ করা হচ্ছে। যদিও টাকার পরিমাণ বেশি নয়, তা সত্ত্বেও অধিক বিয়েকে নিরুৎসাহিত করার জন্য ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের বিধানের মতো এটিও একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৬নং ধারার সহজ পাঠ নিচে তুলে ধরা হলো :

“৬। বহু বিবাহ (Polygamy) :

(১) সালিশী পরিষদের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি একটি বিবাহ বলবৎ থাকলে আরেকটি বিবাহ করতে পারবে না এবং পূর্ব অনুমতি গ্রহণ না করে এই জাতীয় কোনো বিবাহ হলে তা মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সালের ৫২নং আইন) অনুসারে রেজিস্ট্র্রি হবে না।

(২) (১) উপ-ধারায় বর্ণিত অনুমতির জন্য নির্দিষ্ট ফিসসহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এবং আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত বিবাহের কারণ এবং বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কিনা, তা উল্লেখ করতে হবে।

(৩) উপরোক্ত (২) উপ-ধারা মোতাবেক আবেদনপত্র পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আবেদনকারী এবং বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের প্রত্যেককে একজন করে প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে বলবেন এবং এইরূপে গঠিত সালিশী পরিষদ যদি মনে করেন যে, প্রস্তাবিত প্রয়োজন এবং ন্যায়সঙ্গত, তা হলে কোনো শর্ত থাকলে তা সাপেক্ষে, প্রার্থিত বিবাহের অনুমতি মঞ্জুর করতে পারেন।

(৪) আবেদনটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সালিশী পরিষদ সিদ্ধান্তের কারণসমূহ লিপিবদ্ধ করবেন এবং যে কোনো পক্ষ, নির্দিষ্ট ফিস জমা দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট সহকারী জজের নিকট রিভিশনের জন্য আবেদন দাখিল করতে পারবেন এবং সহকারী জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে ও আদালতে এই সিদ্ধান্তের বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

(৫) সালিশী পরিষদের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে-

(ক) অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের “তাৎক্ষণিক” অথবা “বিলম্বিত” দেনমোহরের যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে এবং উক্ত টাকা পরিশোধ করা না হলে উহা বকেয়া ভূমি রাজস্বের ন্যায় আদায়যোগ্য হবে।

(খ) অভিযোগক্রমে দোষী সাব্যস্ত হলে সে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।”

একজন মুসলমান পুরুষকে আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করেই বহুবিবাহ করতে হয় বিধায় এতে ব্যয়ের সম্পৃক্ততা আছে। অতএব তিনি যা করতে সামর্থ্য রাখেন তাতে সিটি কর্পোরেশনের কর থেকে কেন অব্যাহতি পাবেন? এছাড়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ভঙ্গ করলে যেখানে জরিমানা ও কারাভোগের বিধান রয়েছে সেখানে ব্যক্তিটি কর পরিশোধ থেকে অব্যাহতি পাবেন কেন? সাংবিধানিকভাবেও বিষয়টি বৈষম্যমূলক নয় কি? এ ক্ষেত্রটি নিশ্চয় মানবাধিকার সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলোর চোখ এড়াবে না। 

কোনো দেশে বিয়ের ওপর কর ধার্যের তথ্য হাতের কাছে না থাকলেও বিয়ে অনুষ্ঠানের হল, ক্যাটারার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপের তথ্য পাওয়া যায়। বিয়ে করলে কর অব্যাহতি পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ফ্রান্সে। আবার জাপানে বিবাহোত্তর কালে মা-বাবাকে সঙ্গে রাখার জন্য কর অব্যাহতি মেলে। 

কর আরোপ বা অব্যাহতির বিষয়টি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনকে কেন্দ্র করেও আবর্তিত হয়। ভারতে বিয়ের সময় বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে প্রাপ্ত গিফট ৫০,০০০ রুপি অতিক্রম করলে তা করের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও বাবা,মা, আত্মীয়-স্বজনের নিকট থেকে প্রাপ্ত উপহারকে করের আওতায় আনা হয়নি। পাকিস্তানে এ বছরের গোড়ার দিকে বিয়ের কনভেনশন হল, ক্যাটারার ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রিম কর আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল। 

অন্যদিকে নির্ধারিত সংখ্যার অধিক অতিথি আপ্যায়নকে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই করের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটি এখনো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এমনটি বলার অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। এ বছরের গোড়ার দিকে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ১০ হাজারের বেশি মানুষকে সন্তানের বিয়েতে আপ্যায়ন করেন মর্মে পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনুমোদিত ১০০ জনের অতিরিক্ত ৯,৯০০ জনকে আপ্যায়নে তার অন্তত ১০ লাখ টাকার অধিক অর্থ অতিথি আপ্যায়ন খাতে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা। তিনি কি তা করেছেন? যদি না করে থাকেন তার বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি? যদি না হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এ বিষয়ে সরকারি-বিরোধী দল, সরকারি কর্মচারী-আমলা, ব্যবসায়ী, জোতদার প্রমুখ সবাই একজোট। এজন্য সরকার কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বিবাহ সম্পর্কিত করের ক্ষেত্রে এমনতর অভিজ্ঞতা ‘সিটি করপোরেশন কর তফসিল’ প্রণয়নে কোন মন্দ সংকেত দিয়েছে কি? 

এবারে আসা যাক হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে। হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২-এর ৩ ধারা নিম্নরূপ

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন

৩। (১) অন্য কোনো আইন, প্রথা ও রীতি-নীতিতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, হিন্দু বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে হিন্দু বিবাহ, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নিবন্ধন করা যাইবে।

 (২) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো হিন্দু বিবাহ এই আইনের অধীন নিবন্ধিত না হইলেও উহার কারণে কোনো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন বিবাহের বৈধতা ক্ষুণ্ণ হইবে না।”

অর্থাৎ বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। কেউ ইচ্ছে করলে নিবন্ধন করাতে পারেন মাত্র। সেক্ষেত্রে ‘বিবাহ কর’ নিবন্ধকের মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে আদায় করা সম্ভব নয়। এছাড়া হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠান শাস্ত্রীয় বিধান অনুসরণে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্দিষ্ট বা বিশেষ স্থানে সম্পন্ন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। এক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে।

অন্যদিকে বৌদ্ধদের মধ্যেও বিবাহ নিবন্ধনের পৃথক আইন বা বিধান নাই। কেবল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে গির্জাতে সম্পন্ন হওয়ায় গির্জা ও খ্রিষ্টান ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিষয়টির দেখভাল করা সম্ভব হতে পারে।

অনেকে ভাবতে পারেন ‘কর’ আরোপের বিরুদ্ধেই সাধারণত মানুষ অবস্থান নিয়ে থাকে। কিন্তু এই লেখাটি শুধু কর আরোপকে সমর্থন করছে না, উপরন্তু করের ক্ষেত্র বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠায় আদাজল খেয়ে লেগেছে। এর কারণ কী?

এর প্রথম এবং প্রধান কারণ পারিবারিক শান্তি ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারলে তা শুধু পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত করে না, সমাজের শ্রীবৃদ্ধিতেও অবদান রাখতে পারে। অতএব একাধিক বিয়ে যেন অপরিহার্য ক্ষেত্রে হয় তার জন্য প্রক্রিয়াগত প্রেক্ষাপট থাকা অপরিহার্য। ‘বিবাহ কর’ এই উদ্দেশ্য সাধনে পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অনুমিত হয়।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //