আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

শুরু হয়েছে হিজরি ১৪৪৫ সাল। আজ হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মহররম মাসের ১০ তারিখ (২৯ জুলাই)। আজ পালিত হবে মহিমান্বিত দিবস আশুরা। দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব ইতিহাসের অনেক অবিস্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই সারা মুসলিম বিশ্বে দিনটির মর্যাদা ও তাৎপর্য স্বীকৃত।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা হিজরতকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় হিজরি বর্ষপঞ্জি, যা গোটা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনুসরণীয় কালনির্দেশিকা। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে হযরত আলী (রা.) প্রস্তাব অনুযায়ী আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর হিজরতের ঘটনাকে মাইলফলক হিসেবে গণ্য করে নতুন সন পঞ্জিকা চালু করেন।

চান্দ্রমাসের গণনা অনুযায়ী বছরের হিসাব করা হয় হিজরি সালের। কেননা ইসলামের ইবাদতসমূহের বার্ষিক হিসাব চান্দ্রমাসের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। এই ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররম ইসলামের আগেও সম্মানিত হিসেবে গণ্য ছিল। আরবরা এই মাসসহ চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখত। অন্য তিন মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও রজব। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের বাণী তাদের কাছে না থাকলেও আরবরা মহররম থেকেই বছরের শুরু হিসাব করত এবং হজের মৌসুম তিন মাস ও রজব মাসের সম্মান করত।

মহররম মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। 

সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবীর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার। বস্তুত আশুরার এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিন তারা এক স্থানে মিলিত হন। হযরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ কয়েক মাস প্লাবনের পানিতে ভাসার পর এই দিনে জুদি পাহাড়ের গায়ে এসে লাগে। 

হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে সমকালীন জালেম শাসক আগুনে নিক্ষেপ করলে আল্লাহর নির্দেশে সেই আগুনের গর্ত পরিণত হয় ফুলের বাগানে। এই দিনেই ঘটনাটি ঘটেছিল। হযরত ইদরিস (আ.)-কে এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হযরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘকাল পর এই দিনে পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হযরত মুসা (আ.) এই দিনে তূর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। ফেরাউনের কবল থেকে হযরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের নিষ্কৃতি লাভের ঘটনাও ছিল এদিনে। এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবছর আশুরার দিন। তেমনি কিয়ামতও এই দিনেই সংঘটিত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মহানবী (সা.)।

কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা এই দিনের অন্যসব স্মৃতিকে ম্লান করে দিয়েছে। শেষ নবী (সা.)-এর আদরের নাতি, শেরে খোদা হযরত আলী (রা.) ও জান্নাতে রমণীকুলের নেত্রী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি হযরত হুসাইন (রা.) ও তার সাথিরা বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কুফা নগরীর অদূরে কারবালা প্রান্তরে এই দিনেই নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন ইয়াজিদ নিযুক্ত আঞ্চলিক গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। 

কিন্তু আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্চস্যপূর্ণ নয়। আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। বরং হযরত হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া ও তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন।

ইবাদতের দিন আশুরা। বিশেষ করে এ দিনে নফল রোজা রাখার নির্দেশনা এসেছে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে। এমনকি ইসলামের আগেও এ দিনে রোজা রাখার রীতি ছিল। তিরমিজী শরীফে বর্ণিত আছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, আরবরা জাহেলী যুগেও আশুরার দিনে রোজা রাখত। আল্লাহর রাসূল (সা.)ও এদিনে রোজা রাখতেন। তারপর তিনি হিজরত করে মদীনায় এসে নিজেও রোজা রাখলেন, মুসলমানদেরকেও রোজা রাখার আদেশ দিলেন। পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আয়াত নাযিল হলো, তখন থেকে আশুরার রোজা নফল বা ঐচ্ছিক হয়ে গেল। আরেক বর্ণনায় আছে, আল্লাহর শেষ নবী (সা.) মদীনায় এসে দেখলেন, এখানকার ইহুদিরা রোজা রেখেছে এবং এ দিনটিকে তারা বিশেষ মর্যাদা দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, হযরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে এই দিনে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দান করেছিলেন। এজন্য হযরত মুসা (আ.) এদিনে রোজা রাখতেন। এ কথা শুনে মহানবী (সা.) ইরশাদ করলেন, হযরত মুসার (আ.) সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ। এই বলে তিনি মুসলমানদেরকে আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে তিনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য আশুরার আগের দিন বা মহররম মাসের নবম তারিখেও রোজা রাখার পরামর্শ দিলেন।

হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, মর্যাদার দিক দিয়ে আশুরার রোজা তিন ধরনের। সর্বোচ্চ মর্যাদা হলো আশুরার সঙ্গে আগের দিন ও পরের দিন মোট তিন দিন রোজা রাখা। দ্বিতীয় পর্যায় হলো আশুরার সঙ্গে আগের দিনও অর্থাৎ দুই দিন রোজা রাখা। আর ন্যূনতম হলো শুধু আশুরার দিনে রোজা রাখা।

আশুরার দিনের রোজার ফযীলত প্রসঙ্গে সাহাবী হযরত আবু কাতাদা (রা.)-এর বরাতে তিরমিজী শরীফেই বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন- আমি আশা করি আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা পেছনের এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। 

অতএব আশুরার দিনের প্রধান কর্তব্য রোজা রাখাসহ ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকা। শোক মিছিল ও এ জাতীয় কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থিত নয়। এগুলো বিদয়াত। এগুলো পরিহার করা প্রয়োজন। বরং শ্রেষ্ঠ নবীর অনুসারীরা এ শুভ লগ্নে তাদের কর্তব্য ও পালনীয় সম্বন্ধে সচেতনতার নবায়ন করবে। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর দৃঢ়বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম উম্মাহকে আবার এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প করতে হবে এবং নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করতে হবে এ দিনে। এটাই এদিনের প্রধান বার্তা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //