শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন : তেহারি ও আরও কিছু স্মৃতি

এক প্লেট তেহারির দাম ১২৫ টাকা শুনে মনটা দমে গিয়েছিল। আমি হয়তো এই দামে বাড়ির জন্য মাঝেমধ্যে কিনতে পারি কিন্তু অনেকেই তো পারবে না। দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে পড়ল ঢাকা ইউনিভার্সিটির শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের কথা।

আমরা দেড় টাকায় এক প্লেট তেহারি খেতাম। ভালো না খারাপ জানি না, তবে এটা জানি ওটা আমাদের আপন আহার ছিল। সেই দিক থেকে ৮ আনার পর ১ টাকার চা, দেড় টাকার তেহারি আর এক প্যাকেট স্টার সিগারেট খেয়ে দিন পার করতাম। জিনিসপত্র অতটা ব্র্যান্ডেড ছিল না। আমাদের জীবনটাই ছিল ব্র্যান্ড।

দুই

আমরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ব্যাচ এবং এটা নিয়ে আমাদের অনেক অহং/গর্ব আছে। আমরাই স্বাধীন দেশের প্রথম ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া, এ রকম কিছু। আসলে এতে কিছুই এসে যায় না।কিন্তু আবার এটাও ঠিক যে আমরা একটা নতুন ধারা নিয়ে আসি। এক ধরনের চলাফেরা, এক ধরনের স্টাইল, ‘নো ফালতু মনোভাব’, কিছু করে দেখানো এই আর কি। তবে কেবল আমরা না। যারাই স্টুডেন্ট ছিল, তারা সবাই এতে আক্রান্ত হয়, আগে পিছে। এমন দিনকাল আর আসবে না। আমাদের পাখা মেলার কাল। আর তাতে বড় ভূমিকা রাখে এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন।

তিন

একেবারেই নিরামিষ একটা ছাপড়া দোকান, বসার জন্য বেঞ্চি। সামনেটা খোলা। প্রথমে ছিল লাইব্রেরির সামনে, পরে চলে যায় তার পেছনে। মালিকের নাম শরীফ মিয়া, সাথে তার শ্যালক রমজান মিয়া। আর একটা চক্র ছেলে ছিল। পেদ্রো নামটা মনে আসে কিন্তু ওটা বোধহয় পাশের ক্যান্টিনের ছেলেটার নাম। ওটাই ছিল আমাদের অনেকের ঠিকানা।

চার

কয়েকটি জায়গা ছিল আড্ডা দেবার, মিলিত হবার, চা খাবার ক্যাম্পাসে। টিএসসি ছিল এক দলের জন্য, ওটা আমরা নয়। তবে ছেলে মেয়েরা যারা প্রেম করত অনেকেই যেত সেথায়। আমরা ক্যান্টিন পার্টি। এদের মধ্যে মূল ছিল দুইটা। মধুর ক্যান্টিন যেটা ছিল রাজনীতির কেন্দ্রস্থল আর শরীফ মিয়া যাতে সাহিত্যিকদের দাপট ছিল বেশি। মধুর কালচার অন্যরকম, দানা পানিও ছিল একটু আলাদা, একটু উন্নত। অনেকেই ওখানে সকাল বেলার নাশতা করত। শরীফ মিয়ার নাশতা অত গর্জিয়াস ছিল না। 

পাঁচ

খাবার এমন তুলকালাম কিছু ছিল না। আমরা যারা ঘরের খেয়ে বনে ঘুরতাম, আমরা ছিলাম নাশতার সন্ধানী। বুটের ডাল আর পরোটা চলত সকালের দিকে, দুপুরে পাওয়া যেত তেহারি বা যেটাই হোক। দামি খাবার নয় তবে মজাদার। শিঙাড়া পাওয়া যেত, আরও দু-একটা আইটেম। ওই খাবারের সাথে কোনো কিংবদন্তি জড়িত নাই, আছে সব মিলিয়ে যে পরিবেশ ছিল তাতে। আজও আছে। আমরা গেলে চলে যাবে। তবে একবার যারা ওইকালে সেখানে ছিল, তাদের কাছে ওটাই বেড়ে ওঠার, বড় হবার স্থান। আসলে ওই ক্যান্টিন, ওর মালিক আর খদ্দেরসহ সবাই মিলে ছিল এক নয়া সংস্কৃতির কারিগর।

ছয়

যারা যাওয়া-আসা করত তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটু বেশি যেত। নির্মলেন্দু গুণ দা যেমন একজন। কখন আসতেন জানি না, তবে গেলেই পাওয়া যেত। যদিও আমাদের চেয়ে সিনিয়র, কিন্তু সজ্জন মানুষ ছিলেন। তার কবিতা তার জীবন যাপনের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটত। একটু শরাফাত ভাব ছিল ওনার মেজাজে। আমাদের দিলু রোডের বাসায় মাঝেমধ্যে যেতেন। আমার বাবা-মাকে খালা আম্মা-খালু ডাকতেন। অনেক মানুষই যেত তবে গুণদার ব্যবহারের গুণে তাকে ওনারা পছন্দ করতেন। একদিন তাই বললাম, ‘আসলে গুণ দা তো চৌধুরী, কিন্তু নামটা ব্যবহার করেন না।’ বাবা শুনে খুশি, আর এক চৌধুরী পাওয়া গেল।

সাত

হেলাল ভাই- হেলাল হাফিজ ভাই- ঘুম থেকে উঠে চলে আসতেন মনে হয়। ওটাই ছিল তার ঠিকানা। আমার প্রথম গল্পটা ছাপা হয়, ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায়, সাহিত্য সম্পাদক তিনি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম অফিসে যাব কিনা গল্পটা জমা দিতে। উনি বলেন, ‘কেন? আমি তো আমার ঠিকানাতেই থাকব।’ কবি আবুল হাসান থাকতেন, একটু চুপচাপ মানুষ। উনাদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগত। কারণ কেউ ভাব নিত না। আরও বহু নাম ...

আট

বিপন্ন, বিষণ্ণ, অস্থির মানুষরাও আসত, ঢাকার সবচেয়ে নিরাপদ ঠিকানায়। ওখানে কেউ কাউকে কিছু বলত না, সবাই আমন্ত্রিত। মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষজন আসত, কেন এরকম জানি না। কেউ কবি, কেউ বিপ্লবী। গুণদার একটা কবিতার বইয়ের শিরোনাম ছিল, ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’। তারা আসত, বসত। কেউ না কেউ চা-শিঙাড়া খাওয়াত, আবার চলে যেত। আবার এমন মানুষ দেখেছি যিনি চোখের সামনে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলেন। যেমন কবি সাবদার সিদ্দিকী। শেষ দেখা ওখানেই। সবাই ত্যাগ করলেও ওই ক্যান্টিন করেনি কাউকে। যেন আমাদের গোটা মন জগতের নির্মাণ। কিছু বা কাউকে বাদ দেওয়া যায় না।

নয়

যেদিন উচ্ছেদ হলো সেদিনের কথা মনে আছে। লাইব্রেরির পেছন থেকে পুলিশ দিয়ে ছাপড়াটা ভাঙা হলো। অসহায় শরীফ মিয়া, রমজান মিয়া, মাটিতে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। ওই ক্যান্টিন চলে যাওয়া মানে একটি প্রজন্মের ভাবনা-চিন্তার প্রতীকী সাক্ষীর বিদায়। পরে ওই ক্যান্টিন ঠাঁই পায় আর্ট কলেজে। একবার গিয়েছিলাম দেখা করতে। খুব খুশি হয়েছিলেন কিন্তু ওটা আর তখন আমাদের নেই।

দশ

তেহারির কথা বলব বলে শুরু করেছিলাম। ওটা তো আহার না, ওটা প্রতীক। মনে আছে সদ্য বিবাহিত ইউনিভার্সিটি শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ, কাজ করা পাঞ্জাবি পরে ক্যান্টিনে তেহারি খাচ্ছেন। মনে আছে পাস করে যাওয়া মানুষ চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে মাসে একবার তেহারি খেতে আসে। মনে পড়ে ওইটা আর নাই। অনেকেই নেই, কিন্তু ছিল এটাই সত্য। বেঁচে থাকো শরীফ মিয়ার চা, শিঙাড়া, তেহারি ...


লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //