মৃত মানুষ যে দেশে মামলার আসামি!

‘বাঙলা কলেজে ভাঙচুর: মামলায় বিএনপির ২ মৃত নেতা আসামি’। সম্প্রতি এরকম একটি খবর দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। বলছেন, মৃত মানুষ কী করে মামলার আসামি হয়? তারা কি কবর থেকে উঠে এসে কলেজে ভাঙচুর চালিয়েছেন, নাকি তাদের প্রেতাত্মা এসে আক্রমণ করেছে- এরকম রসিকতাও আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর চেয়ে আরও বড় ঘটনাও ঘটে। ঘটেছে।

পিয়ারা আক্তার নামে পিরোজপুরের এক নারী ২৪ বছর জেল খেটে বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, বিনা অপরাধে তিনি যে জীবনের দুটি যুগ কারাগারে কাটালেন, তার এই সময় কে ফিরিয়ে দেবে? পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায় তার এক চাচাতো বোনের মৃত্যুর পর দায়েরকৃত হত্যা মামলায়। পুলিশ তাকে যা শিখিয়ে দেয়, তিনি সেভাবেই আদালতে কথা বলেন। অতঃপর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া একজন শিশুর ঠাঁই হয় কারাগারে। মামলার রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২৪ বছর জেল খেটে তিনি মুক্ত হন। তার মুক্তির পর বরিশালের সাবেক জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জসীম উদ্দীন হায়দারও বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। 

ক্লাস ফাইভের বাচ্চার তো এই আদালতে বিচার হওয়ার কথা নয়।’ (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৩০ জুন ২০২১)।

প্রশ্ন হলো, কার ভুলে একটি শিশুর শৈশব খুন হলো; কৈশোর গেল; যৌবনে কারামুক্ত হয়ে তিনি যে অকুলপাথারে পড়লেন, সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে? 

১৯৯২ সালে বাসে ডাকাতির অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাবুল মিয়া যখন গ্রেপ্তার হন, তার বয়স তখন ১৮ বছর। কিন্তু ২০১৭ সালে তিনি যখন আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং খালাস পান, তখন তার বয়স ৪৩। অর্থাৎ নিজের জীবনের কৈশোরের একাংশ, তারুণ্য এবং যৌবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন জেলখানায়। (বিবিসি বাংলা, ২৭ জানুয়ারি ২০২১)।

জাহালমের নামও নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি। বিনা দোষে তিন বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পান পাটকল শ্রমিক জাহালম। হাইকোর্ট তার মুক্তির আদেশে বলেছিলেন, ‘কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে না আমরা। এই ভুল তদন্তে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কি না, সিন্ডিকেট থাকলে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে আদালতকে জানাতে হবে। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে। এরকম ভুলের দায় দুদক কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে সত্যিই উঠে এলো যে, তদন্ত কর্মকর্তার ভুলের কারণে আসামি না হয়েও জাহালমকে কারাভোগ করতে হয়েছে।

মুশকিল হলো, উচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করলে বা গণমাধ্যমে রিপোর্ট হলেই কেবল এরকম ঘটনাগুলো জানা যায়। কিন্তু যাদের কারণে এইসব অদ্ভুত কা- ঘটে, তাদের কখনো জবাবদিহি বা বিচারের আওতায় আসতে হয় না বলে এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হয় না। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৮ জুলাই রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজে ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির ১০৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেখানে দুজন মৃত ব্যক্তির নামও রয়েছে। তাদের একজন আবদুল জব্বার। যিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর। একই মামলায় বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম সুমনকেও আসামি করা হয়েছে। তিনিও প্রায় ৯ মাস আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অথচ মামলার বাদী কলেজের কর্মচারী মহিদুর রহমান জানান, তিনি পুলিশের কাছে কোনো অভিযুক্তের নাম দেননি। প্রশ্ন হলো, পুলিশ কি তাহলে অতি উৎসাহী হয়ে এই নামগুলো দিল? কেন? 

দেশের প্রায় সব জায়গায় দুয়েকজন চিহ্নিত লোক থাকে। যে কোনো ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে তাদেরকে ধরে বা সন্দেহ করে। যেমন কোথাও ছিনতাই, চুরি বা খুন হলে ওই এলাকায় যার এ ধরনের রেকর্ড আছে তাকে ধরে। কোথাও বোমা বিস্ফোরণ হলে সব আমলেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাই টার্গেটে পরিণত হন। অথচ সব সময় সব ঘটনা একই লোকেরা নাও ঘটাতে পারেন, সবার সংশ্লিষ্টতা নাও থাকতে পারে। কিন্তু যে কোনো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলে সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার ভাষা, আসামি এবং তদন্ত একই বৃত্তে ঘুরপাক খায়। এটি সব আমলেই। রাজধানীর মিরপুর এলাকায়ও আবদুল জব্বার হাওলাদারই কেষ্ট। প্রতিবারই তিনি মামলার আসামি। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। অথচ লোকটি মারা গেছেন দুই বছর আগে।

মৃত ব্যক্তিকে যখন কোনো মামলার আসামি করা হয়, তখন ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের মনের কী অবস্থা হয়, সেটি রাষ্ট্র জানে? যাদের কারণে দেশের বিচারব্যবস্থা এরকম প্রশ্নবিদ্ধ হয়; নিরপরাধ লোক বছরের পর বছর জেল খাটেন অথচ অপরাধীরা পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়- তাদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকে? 

গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে মাতুয়াইলে যে বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে, ওই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাসটি পাম্প থেকে বের হচ্ছিল। বাসে শুধু চালক ছিলেন। দুজন লোক এসে চালককে বাস থেকে জোর করে নামান। তারপর বাসে আগুন দিয়ে ভিডিও করেন। এরপর একটি মোটরসাইকেল আসে। তিনজন সেই মোটরসাইকেলে চলে যায়।’ একই কথা বলেছেন বাসটির চালকও। তিনি বলেন, ‘গাড়িটা ব্যাক দিয়া সোজা করতে লইছিলাম। এ সময় হোন্ডা লইয়া তিনজন লোক আসল। দুজন গাড়িতে উঠল। তারা বলল, নামবি নাকি তর ওপরে প্যাট্রোল মারমু। আমি স্টার্ট বন্ধ কইরা দিছি। লাফ দিয়া পইড়া গেছি। ওরা আগুন লাগাই দিয়া বাইকে করে চলে গেছে। এ সময় পুলিশ পাঁচ-ছয় হাত দূরেই ছিল। দুই পাশেই পুলিশ ছিল।’

প্রশ্ন হলো, পুলিশ কি এই তিনজনকে খুঁজে বের করে তাদের পরিচয় জানাতে পারবে? ওই এলাকায় যদি সিসি ক্যামেরা থাকে তাহলে তার ফুটেজ দেখেও কি অপরাধীদের চিহ্নিত করা যাবে? যদি সত্যিই তারা বিরোধীদলীয় কর্মী না হন, তাহলে পুলিশ কি তাদের খুঁজে বের করবে বা করতে পারবে? নাকি এই বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায়ও পুলিশ এমন কাউকে আসামি করবে যিনি বা যারা ওই ঘটনার সময়ে আশেপাশেই ছিলেন না? 

বস্তুত জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, রাজনৈতিক সহিংসতার নামে মামলা বেড়ে যায় মূলত প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে মামলা। কারণ মামলা হলেই লোকেরা পুলিশের গ্রেপ্তার ও কারাগার এড়াতে পালিয়ে বেড়ায়। তখন প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে যায়। যে কারণে প্রতিটি ঘটনার পরই মামলায় আসামি হিসেবে যত জনের নাম উল্লেখ করা হয়, অজ্ঞাত আসামি করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। অজ্ঞাত আসামি দেওয়ার সুবিধাই হলো এই যে, পুলিশ ওই মামলার সন্দেহজনক আসামি হিসেবে যখন যাকে খুশি গ্রেপ্তার করতে পারে। যেমন মিরপুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও ১০৯ জনের নামে এবং অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মুখোশ পরে দুই যুবলীগ কর্মীর ওপর হামলা ও মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১২৫ জন নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সময়ে খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়ার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা সহস্রাধিক আসামি করা হয়। এর আগে সংঘর্ষের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা ও আহত করার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৫৭ জন বিএনপি নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ আরও ৫-৬ শতাধিক অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২১ সালে রংপুরের হারাগাছে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাজুল ইসলাম নামে এক লোকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা থানায় যে হামলা ও ভাঙচুর চালায় তাতে দুটি মামলা করে পুলিশ, যেখানে আসামি করা হয় অজ্ঞাত তিনশ জনকে। যেহেতু আসামি অজ্ঞাত, অতএব যে কেউ যে কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন, এই আতঙ্কে এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে যায়।

হারাগাছের এই ঘটনার অব্যবহিত আগে কুমিল্লার একটি পূজাম-পে কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে ১৬ জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর, পূজাম-প, মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়ের করা ৮৫টি মামলায় ২৩ হাজার ৯১১ জনকে আসামি করা হয়, যেখানে অধিকাংশ আসামিই অজ্ঞাত। প্রশ্ন হলো, ২৪ হাজার লোক কি এসব হামলায় অংশ নিয়েছে? যেহেতু আসামি অজ্ঞাত, ফলে এসব এলাকায়ও গ্রেপ্তার এড়াতে বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে যায়। কিন্তু বছরের পর বছর চলে গেলেও পুলিশ অনেক বড় ঘটনারই কূলকিনারা করে না বা করতে পারে না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি এবং কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর নিহত হওয়ার ঘটনা যার অন্যতম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //