চীনে প্রাচীনযুগে ব্যবহৃত হারানো প্রাকৃতিক স্থাপনা স্কাইওয়েল

বিশ্ববাসী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করে যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে, ঠিক তখন এই উষ্ণতা থেকে বাঁচতে নানাবিধ প্রাকৃততি প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবা শুরু করেছে চীন। বিশ্বজুড়ে দাবদাহে ভোগান্তির শিকার না হয়ে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে কীভাবে উষ্ণায়ন প্রতিরোধ করা যায় সেটি মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পরাশক্তিধর এই দেশটির। শুধুমাত্র যন্ত্রনির্ভর নয় বরং প্রকৃতির নানা উপাদানের কার্যকরী ব্যবহারের মধ্যদিয়ে কীভাবে ঠান্ডা রাখা যায় ঘর-বাড়ি আবাসস্থল, এমন কিছু নিয়েই চীনের স্থপতিরা কাজ করছেন স্কাইওয়েল নামের হাজারবর্ষ পুরোনো এক প্রযুক্তি নিয়ে। 

রু লিং একজন চীনা নাগরিক বর্তমান সময়ে শহরের চাকচিক্যতা হতে বেরিয়ে স্কাইওয়েলে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন। তার কাছে পুরানো চীনা বাড়ির এমন উঠান একটি গরম এবং আর্দ্র দিনে থাকার জন্য উপযুক্ত জায়গা বলে বিবেচ্য হয়ে থাকে। ৪০ বছর বয়সী রু বলেছেন, "এগুলি বাতাসযুক্ত, শীতল এবং ভাল ছায়াময়।"

মূলত ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, রু পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের গুয়ানলু গ্রামে একটি পুরোনো শতাব্দীর প্রাচীন কাঠের ফ্রেমযুক্ত বাড়িতে বাস করে আসছেন। বহু বছর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনে বসবাস ও কর্মস্থল কাটানোর পর জীবন পরিবর্তনের জন্য তিনি সেখানে চলে আসেন বলে তার অভিমত।

"গ্রীষ্মে আমার বাড়ির প্রাকৃতিক শীতল অনুভূতি এতটাই সতেজ ছিল, যা কিনা আধুনিক বিশ্বে একটি বিরল সন্ধান" বলেও মন্তব্য তার।  

রু বলেছেন, বাড়ির স্কাইওয়েল একটি শীতল প্রভাব তৈরি করতে সাহায্য করে যা গরম আবহাওয়ায় বেশ উপযোগী। আর স্কাইওয়েলের সুবিধার এমন প্রশংসা তিনি একা নন বরং হালের সময়ে সবার মুখেই ফিরে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ চীনের কিছু স্কাইওয়েলের ভিতরের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম (- ৪.৩ ডিগ্রি) থাকে। 

আজকের দ্রুত নগরায়নমুখী চীনে এমন স্কাইওয়েল আবাসনে কম লোক বাস করলেও এদিকেই ক্রমশ লোকেরা ফিরে আসতে চাইছে। 

স্কাইওয়েল হলো মূলত ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যকলার অন্যতম এক নির্মাণশৈলী যেখানে বাইরের থেকে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রাকে রাখে যথেষ্ট সহনশীল।

এদিকে ঐতিহ্যবাহী চীনা এসব স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মানোয় ঐতিহাসিক বেশ কিছু ভবনকে আধুনিক সময়ের জন্য যুগোপযুগী করে বিনির্মাণ করতে প্রস্ততি নিচ্ছেন স্থপতিগণ। ইতিমধ্যে, সরকারি উদ্যোগে বিল্ডিং সেক্টরে কম কার্বন নিঃসরণ হওয়া এমন ভবন তৈরিতেও বেশ নড়েচড়ে বসেছে চীন সরকার। আর এ প্রবণতা থেকেই দেশটির স্থপতিরা নতুন নির্মাণাধীন ভবনগুলোকে শীতল রাখতে স্কাইওয়েল প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ওপর জোর তাগিদ দিচ্ছেন। 

স্কাইওয়েল, বা ম্যান্ডারিন ভাষায় যাকে "তিয়ান জিং" বলা হয়। যা মূলত দক্ষিণ এবং পূর্ব চীনের বাড়িগুলো এমন বৈশিষ্ট্যের আদলে নির্মিত। উত্তর চীনা অঞ্চলের বাড়িগুলোর আঙ্গিনা বা "ইউয়ান জি" নামে পরিচিত স্কাইওয়েল ছোট আকৃতির হয়ে থাকে। 

এ অঞ্চলের বাসিন্দারা সাধারণত মিং (১৩৬৮-১৬৪৪) এবং কিং (১৬৪৪-১৯১১) রাজবংশের বাড়িগুলোতে এমন স্থাপত্যকলার সন্ধান পেয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন প্রজন্মের সময় তাদের  আত্মীয়দের থাকার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। পরে ২০১০ সালের চীনের নানচাং বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র অনুসারে এসব বাড়ির সন্ধান পায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।

গবেষকরা বলছেন, একটি স্কাইওয়েলের আকার এবং নকশা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে এটি প্রায় সবসময় আয়তক্ষেত্রাকার এবং একটি বাড়ির মূল অংশে অবস্থিত হয়। স্কাইওয়েল চার পাশের কক্ষ দ্বারা বা তিন পাশে একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা থাকে। আর কিছু বড় বাড়িতে একাধিক স্কাইওয়েল রয়েছে।

সিচুয়ান, জিয়াংসু, আনহুই এবং জিয়াংজির মতো দক্ষিণ ও পূর্ব চীনের বিশাল অংশজুড়ে পুরোনো ঐতিহাসিক এসব বাসস্থানগুলোতে তুলনামূলকভাবে স্কাইওয়েলের খোঁজ পাওয়া যায়। 

প্রাচীনযুগে স্কাইওয়েল মূলত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যখন কিনা আবিষ্কার হয়নি এমন যুগে ভবনগুলোকে শীতল রাখতে এটি কাজ করত। 

এটি এমন এক পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি যেখানে একটি স্কাইওয়েল বাড়ির উপরে বাতাস সরাসরি সাহায্য করে থাকে। কারণ খোলা থাকার কারণে ও আকাশ্মুখী এর অবস্থান হওয়ায় খুব সহজেই বাড়ির অভ্যন্তরে বায়ু চলাচলে এটি কার্যকরি। যেহেতু বাইরের বাতাস প্রায়ই ভিতরের বাতাসের চেয়ে শীতল হয়, তাই বাতাসের ধর্মুনুযায়ী দেয়ালের নিচের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর এমন অবস্থায় উষ্ণ অভ্যন্তরীণ বায়ু প্রতিস্থাপন করে বায়ুপ্রবাহ তৈরিতে স্কাইওয়েল চমৎকার ভূমিকা পালন করে। ফলে খোলা স্থানের মধ্য দিয়ে বাতাস ওঠানামা করে সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে বেশ কার্যকর রাখে স্কাইওয়েল। 

ইউহং গ্রামের জিয়াংসি অঞ্চলের উয়ুয়ান প্রদেশে স্কাইওয়েল সমৃদ্ধ বাড়িগুলো পুনরুদ্ধারে করতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছে চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বেশ সুপরিচিত। 

স্কাইওয়েল সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন এমন একজন জানান, আলো প্রবেশের অনুমতি, বায়ুচলাচল উন্নত করা এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহ করায় এটি অন্যতম।

বাড়ির অভ্যন্তরে গরম বাতাস বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ায় এটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনেকটা চিমনির মতো কাজ করে স্কাইওয়েল।

ইউ নামের একজন স্থপতি বলছেন, পুরনো ধাঁচের হুইঝো বাড়িগুলোতে নিচতলায় সাধারণত খুব উঁচু সিলিং সরাসরি স্কাইওয়েলের দিকে মুখ করে থাকে। ফলে বায়ুচলাচলের জন্য আদর্শ এটি। আরও বলেন, প্রাচীনকালে ধনী পরিবারের সদস্যরা দুটি বা তিনটি স্কাইওয়েল স্থাপন করতেন যাতে করে আরও ভাল বায়ুচলাচল সম্ভব হয়। 

যদিও স্কাইওয়েল সমৃদ্ধ ভবনগুলো চীনে কয়েকশ বছর ধরে প্রচলিত ছিল কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের নগর সভ্যতায় এটি বিলুপ্তের পথে । আর তাই গত দুই দশক ধরে ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থপতিরা এগুলো পুনরুজ্জীবিতের কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে আবারও ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির বৃহত্তর পুনরুত্থানের একটি অংশ স্কাইওয়েলযুক্ত বাড়িগুলো আধুনিক সভ্যতার কাছে প্রত্যাবর্তন করা শুরু করেছে। 

জানা যায়, একসময়ের পরিত্যক্ত ৩০০ বছরের পুরোনো এমন একটি বাড়ি ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন বিপণন পরিচালক এডওয়ার্ড গাউন এবং তার চীনা স্ত্রী লিয়াও মিনক্সিন কিনেছিলেন। আর এই দম্পতি তিনতলা বাড়িটিকে ১৪ কক্ষের বুটিক হোটেলে রূপান্তরিত করেছিলেন। 

যদিও তাদের সমস্ত গেস্টরুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র লাগানো ছিল। তা স্বত্ত্বেও তারা স্কাইওয়েলের চারপাশের স্থানগুলোকে অক্ষত অবস্থায় রেখেছিলেন। গাউন বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই  স্কাইওয়েলযুক্ত স্থানগুলো গ্রীষ্মে খুব আরামদায়ক ছিল। 

বর্তমানে দেশটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও স্কাইওয়েল কনসেপ্ট আবারও ফিরিয়ে এনে কার্বনমুক্ত নগর সভ্যতা গড়তে বেশ জোরালো পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে, যেখানে সবুজের সংস্পর্শে নতুন সভ্যতার পরিপূর্ণতার স্বাদ আস্বাদনে চীনা নাগরিকরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি আবাসযোগ্য আবাসস্থল রেখে যেতে পারেন।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //