সমতলের আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হবে কি

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন গত ৭ আগস্ট তার ফেসবুক ওয়ালে বিনাদি সরেন নামে এক তরুণের একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছেন। শেয়ার করা ওই পোস্টে বিনাদি লিখেছেন, ‘গতকাল আমরা রাজশাহীর তানোর এলাকাতে খেলতে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক হোটেলে খেতে গিয়ে আমাদেরকে খাবার প্লেট থেকে শুরু করে পানি খাওয়ার গ্লাস, চা খাওয়ার কাপ, সবকিছু আলাদা দিচ্ছে। এই সব কেনরে ভাই, আমরা কি মানুষ না? আমাদের রক্ত কি আপনাদের থেকে আলাদা? তাহলে কেন আমাদের খাবার প্লেট, থেকে শুরু করে পানি খাবার গ্লাস, চা খাবার কাপ আলাদা হবে বুঝি না।’

মানিক সরেন আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘কোনোদিনও কি রাজশাহী, তানোর, এলাকার এই আচরণটা পরিবর্তন হবে না, নাকি সারাজীবন আমাদের জাতকে নিচু চোখে দেখা হবে।’ 

রাজশাহীর তানোরের আদিবাসীরা এমন বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। ২০১১ সালের জুন মাসে তানোর আব্দুল করিম সরকারি ডিগ্রি কলেজের হোস্টেলের আদিবাসী ছাত্রের সঙ্গে একই থালা-বাসনে খেতে অস্বীকার করে সাধারণ ছাত্রদের একটি দল। প্রতিবাদে আদিবাসী ছাত্ররা হোস্টেল ত্যাগ করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আদিবাসী নেতাদের নিয়ে ঘটনার মীমাংসা করতে সালিশে বসেন। সালিশে ঘটনার মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়ে আদিবাসী নেতারা কলেজ থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেতে যান থানার মোড়ের একটা হোটেলে। হোটেল কর্তৃপক্ষ দুই নম্বর থালা-বাসন না থাকার অজুহাতে তাদের খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ঘটনার প্রতিবাদে তখন আদিবাসীরা মানববন্ধন করে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেদিন তানোরের সকল হোটেল মালিক, রাজনৈতিক দলের নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করে হোটেল মালিকদের সতর্ক করে দেন। 

সেই সময়কার ওই ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। দেশের প্রায় সব গণমাধ্যম ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন লিখে ও প্রচার করে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারপর অনেকদিন এমন কোনো ঘটনার কথা শোনা যায়নি। আদিবাসীদের সঙ্গে ওই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সেদিনের সেই প্রতিবাদে সঙ্গে আমরা যারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম তারা আজও গর্ব করি। কিন্তু ৭ আগস্ট মানিক সরেনের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করা পোস্টটি আমাদেরকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছে।

বাংলাদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে ৩০টি জনগোষ্ঠীর মানুষই বসবাস করে উত্তরের সমতল ভূমিতে। তাদের সম্পর্কে আমরা খুব সামান্যই জানি। আদিবাসী মানুষের চাওয়া-পাওয়া খুবই সামান্য। তারা অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে জানে। তাদের সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা ভোগ করে। মিথ্যা বলাকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। ভিক্ষাবৃত্তিকে তারা ঘৃণা করে। তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তা পেলে নাচ-গান করে জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তাদের। সমতলের সাঁওতাল আদিবাসীরা ফুল উৎসব করে। এই উৎসবের আগে তাদের মেয়েরা গাছের পাতা ছিঁড়ে না, খোপায় ফুল দেয় না। উৎসবের সময় তারা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল ছিটিয়ে একে অন্যের মঙ্গল কামনা করে। ফুলের মতোই জীবন তাদের। 

উঁরাও জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা উৎসব করে কারাম গাছকে ঘিরে। এই উৎসবে তারা তাদের দেবতা ধার্মা ও কার্মার কাছে ফসলের জন্য, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। তাদের এই বিশ্বাসের ধার্মা হচ্ছে ধর্ম এবং কার্মা হচ্ছে কর্ম। তাদের কাছে কর্ম ও ধর্ম আলাদা কোনো বিষয় নয়। তারা ভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে। মা যেমন দুগ্ধ পান করিয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি ভূমিও ফসল দিয়ে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। মাকে যেমন ভাগ করা যায় না, তেমনি ভূমিকেও তারা সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে মনে করে। তাদের চিন্তা-চেতনা, সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতি, উৎসব, ঐতিহ্য সবকিছুতেই যৌথ প্রচেষ্টার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। 

বিচ্ছিন্নতার এই সময়ে যৌথ সমাজ কাঠামো নিয়ে টিকে থাকা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে মূল স্রোতধারার মানুষ বলতে গেলে কোনো ধারণাই রাখে না, বরং বেশিরভাগ মানুষই তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। ফলে দিনের পর দিন ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের ভূমি দখল করছে, অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য মনে করে করে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। যা মানুষ হিসেবে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খর্ব করে। এটি স্পষ্টতই মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা চাই, আদিবাসীদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান হোক। 

আজ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদিবাসী তরুণরাই মূলশক্তি’। আমরা বিশ্বাস করি, তরুণদের হাত ধরে আদিবাসীরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরে পাবে। দেশের সকল সাধারণ নাগরিকের মতো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে। আদিবাসীদের ভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং আদিবাসী-বাঙালিসহ সকল প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে উঠবে। 

লেখক : সমাজকর্মী ও আদিবাসী গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //