বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে!

গত রবিবার একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে বলা হয়, বাজারে গরুর মাংসের কেজি প্রায় এক হাজার টাকা। অথচ কিছুদিন আগেই কোরবানির ঈদ শেষ হয়েছে। অনেকের ফ্রিজে এখনো কোরবানির মাংস রয়েছে। কিন্তু তারপরও বাজারে গরুর মাংসের দাম কেন এত চড়া? বছর খানেক আগেও গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।

এক বছরের মধ্যে কোনো একটি পণ্যের দাম কেজিতে কী করে তিন থেকে চারশ টাকা বাড়ে, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেউ দেবেন না। বরং এই কথা বলার লোকের অভাব নেই যে, গরুর মাংস না খেলে কী হয় কিংবা গরুর মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় ইত্যাদি।

গরুর মাংসের মতো বাঙালির আরেকটি আবেগের খাদ্য ইলিশ। অনেক বছর ধরে গরিব মানুষের রান্নাঘরে ইলিশের সুবাস ছড়ায় না। নিম্নমধ্যবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে- অর্থনীতির এই সহজ সূত্র ইলিশে খাটে না। কারণ ট্রলার ভরে মোকামে মাছ এলেও আড়তদাররা সব সময়েই একটা সংকট জিইয়ে রাখেন। ক্রেতাদের বোঝাতে থাকেন যে চাহিদার তুলনায় মাছ কম। অনেক সময় তারা আগের মৌসুমের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ঋণ শোধ করেন।

আবার ভরা মৌসুমে যখন বাজারে প্রচুর ইলিশ দেখা যায়, তখন সচ্ছল মানুষেরা একসঙ্গে বাজারে হামলে পড়েন। যার একটি কিনলেও চলে, তিনি পাঁচ হালি কেনেন। কোরবানির মাংসের মতো ইলিশ কিনে ফ্রিজে ভরে রাখেন সারা বছর খাবেন বলে। ফলে ইলিশের চাহিদা সব সময়ই থাকে তুঙ্গে। অতএব স্বল্প আয়ের মানুষের ইলিশ কেনার সাধ মেটে না। 

গরিবের সন্তানরা বইতে পড়ে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। কিন্তু তাদের কতজন বছরে অন্তত এক পিস ইলিশ মাছ খেতে পায়, সেটি বিরাট প্রশ্ন। এ রকম বাস্তবতায় সম্প্রতি ফেসবুকে একজন মাদ্রাসাপড়ুয়া শিশু বাংলাদেশের জাতীয় মাছ পাঙ্গাশ বলে ভাইরাল হয়েছিল। আসলে সে মাছ বলতে ওই পাঙ্গাশই চেনে। ইলিশ হয়তো কোনোদিন চোখেও দেখেনি। 

কেন ইলিশ মাছ বছরের কোনো একটি সময়ে এসেও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না, রাষ্ট্র কখনো সেটি খতিয়ে দেখেছে? অর্থনীতিবিদরাই বা কী বলছেন?

তারা যা-ই বলুন না কেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে, যখন গরুর মাংসের দাম বাড়ে, তখন বলা হয় গরুর মাংস না খেলে কী হয়? মাছের দাম বাড়লে একই কথা। যখন সবজির দাম বাড়ে, তখন বলা হয় সবজি কম খান। যখন তেলের দাম বাড়ে তখন তেলছাড়া রান্নার পরামর্শ দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়লে সেটি না খাওয়ার কিংবা বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এভাবে বাড়তে বাড়তে মোটা চাল, আলু ও ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিমের দামও কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা ভুক্তভোগীরা জানেন।

নিতান্ত বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে না চাইলে সরকারের বিরোধী পক্ষের লোকজনও এটি স্বীকার করবেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের নানা ক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন হয়েছে, তার অনেকগুলোই অভূতপূর্ব এবং দৃশ্যমান। করোনার অতিমারিতে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতিও যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে ১৭-১৮ কোটি মানুষ নিয়ে ছোট্ট আয়তনের একটি দেশের অর্থনীতি যে ধসে পড়েনি, সেখানে মিরাকল যা-ই থাকুক না কেন, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখানে বড় ভূমিকা পালন করেছে। 

সমালোচনাও আছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি; প্রশাসনের সর্বত্র দলীয়করণ; নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা; ডিজিটাল আইন দিয়ে বিরোধী ও ভিন্নমত দমন করার মতো ইস্যুতে সরকারের সমালোচনাও কম নেই। কিন্তু এই ইস্যুগুলোর অধিকাংশই সরাসরি দেশের অধিকাংশ মানুষকে স্পর্শ করে না। অধিকাংশ মানুষকে স্পর্শ করে চাল-ডাল-আটা-মাছ-মাংসের দাম। গরুর মাংস কিংবা ইলিশ মাছ কিনতে না পারলেও সাধারণ মানুষ অন্তত ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিম এবং চাষ করা পাঙ্গাশ অথবা তেলাপিয়া কিনতে চায়। কোনোমতে রান্না করতে হলেও ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ লাগে। কাঁচামরিচ পরিমাণে কম লাগলেও যখন এর দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়, তখন এটা গরিব মানুষের গায়ে লাগে। 

স্বল্প আয়ের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য আলু। কিন্তু আলুর দামও যদি পঞ্চাশ টাকা কেজি হয়ে যায়, সেটি অসংখ্য মানুষের মন খারাপের কারণ হয়। বস্তুত সারা বছরই কোনো না কোনো নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে বাজার অস্থির থাকে। কখনো তেল, কখনো চাল, কখনো চিনি, কখনোবা সংবাদ শিরোনাম হয় পেঁয়াজ। 

কোনো কিছুর দাম বেড়ে গেলে সেটি না খাওয়ার বা বিকল্প অন্য কিছু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া এক অর্থে যৌক্তিক। কারণ চাহিদা কমে গেলে দামও কমতে থাকে। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কেননা চালের দাম গরিব মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে তখন সেটির বিকল্প খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যাবে না। কারণ চালের বিকল্প আটার দাম আরও বেশি। উপরন্তু ভাত খেয়ে অভ্যস্ত মানুষকে হঠাৎ করে বিকল্প খাদ্যে অভ্যস্ত করা যাবে না। সুতরাং সব সময় সব খাদ্যপণ্যের বিকল্প হয় না। সেজন্যই আসে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। 

কথা হচ্ছে এই মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় যখন ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে রাষ্ট্রকেও জিম্মি করার মতো ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে, তখন সাধারণ মানুষের উপায় কী? আবার সরকারের যদি জনভিত্তি দুর্বল হয়; সরকারের ভেতরেই যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি থাকেন; তখন বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে কী করে? বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কী করতে পারে?

বাস্তবতা হলো, গত ১৫ বছর ধরে সরকার শুধু উন্নয়নের কথা বলছে। উন্নয়নের স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন করতে গিয়ে কী কী বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই আলোচনাটি খুব বেশি হয় না। তার চেয়ে বড় কথা, সরকারের কাজ শুধু বড় বড় ভবন, রাস্তা ও সেতু নির্মাণ নয়, বরং বাজার নিয়ন্ত্রণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালের মধ্যে রাখা তার প্রধান দায়িত্ব। অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে চাকরিজীবী এবং ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষের আয়ের বিরাট অংশ চলে যায় বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়ালেখা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে; সেখানে নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে সেটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে কারণে রাষ্ট্রকে ভাবতে হয়, সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও যাতে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে যা খুশি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকতে হয়।

এটা ঠিক যে, কোনো কিছুর দাম বাড়ার জন্য একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র থাকে। আন্তর্জাতিক বাজার ও পরিস্থিতিও সেখানে অনেক সময় ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, আলু বা অন্যান্য সবজি এবং ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামের সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। 

এই অভিযোগ বেশ পুরনো যে, গ্রাম থেকে এক ট্রাক সবজি ঢাকার বাজারে আসতে আসতে পথে পথে নানা জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। তার সঙ্গে আছে শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট। তারাই দাম নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশ্ন হলো, এই চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ কাজ করছে বা করতে পারছে?

অভিযোগ আছে, মনিটরিং টিমগুলো বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করে বাজারে যায়। আবার বাজারে প্রবেশের আগে বাজার সমিতি ও চেম্বারগুলোকে অবহিত করা হয়। বাজার সমিতি ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেন। ফলে মনিটরিং টিম বাজারে গিয়ে কোনো ত্রুটি পায় না। আবার স্বল্প সময়ে বাজারে অবস্থান করে অনিয়ম বের করা কঠিন। যে কারণে বাজার মনিটরিং টিম চলে যাওয়ার পরই বাজার আগের অবস্থানে চলে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু অভিযোগ আছে, তারা ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নেয়।

বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে আরেকটি কথা বলা হয় যে, এখানে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন। কারসাজি করতে পারেন। কালেভদ্রে কিছু অভিযান হলেও এবং ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়ে না। কারণ ব্যবসায়ীরা যতটা সংগঠিত এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, সাধারণ ভোক্তার মধ্যে সেই ঐক্য নেই। তদারকি ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব একটা শক্তিশালী নয়। তাদের জনবলেরও সংকট আছে।

ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার জন্য কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকেও দায়ী করা হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রের। কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোই যদি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে? গরিব মানুষের সন্তান পাঠ্যবইতে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ পড়লেও তার শ্রমজীবী বাপের যে একটা ইলিশ মাছ কিনে আনার মতো মুরদ নেই, সেই সত্য কথাটি তাকে বলবে কে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //