ইতিহাসের সমাপ্তির সমাপ্তি

ইউক্রেনে বর্বরোচিত রুশ হামলা অর্ধসহস্র দিন অতিক্রম করলেও সমাপ্তির কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধ আসলে কেবল দুটি দেশের মাঝে নয়। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেকেই জড়িত এতে। যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুদেশের সাধারণ মানুষ, মারাও যাচ্ছে। অথচ এর শন্তিপূর্ণ সমাধানে বৃহৎ শক্তিসমূহের কেউই আগ্রহী নয়, যেন একে জিইয়ে রেখে দীর্ঘমেয়াদি ফায়দা হাসিলই তাদের ইচ্ছে।

গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, “এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের চূড়ান্ত বিজয়ের স্বপ্ন প্রত্যেককে টেনে নেবে সম্পূর্ণ পরাজয়ের গহ্বরে। কেবল অস্ত্রব্যবসায়ী ও জীবাশ্ম-জ্বালানি উৎপাদন শিল্পমালিক বাদে, এ যুদ্ধে যাদের কপাল খুলে গেছে।” এ এক নতুন যুদ্ধব্যবস্থা যার গোড়া খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু আগা এখনো বর্ধিষ্ণু বলে শেষকথা বলার সুযোগ নেই। 

গোড়ায় ১৯৯১ সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ইতিহাসের সমাপ্তি ঘোষণা করেন দি এন্ড অব হিস্টোরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। এর কদিন পরই আবার স্যামুয়েল হান্টিংটন বাজিয়েছিলেন সভ্যতার সংঘর্ষের ঘণ্টা। কিন্তু এরপর ভলগা-বুড়িগঙ্গা-হাডসন দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। তবু তো ইতিহাসের খেলা শেষ হইয়াও হইল না শেষ। ফুকুয়ামা বাঁশিতে ফুঁ দিতে না দিতেই বিশ্বরাজনীতির মাঠে শুরু হয়েছিল নতুন খেলা।  

ইতিহাসের উজ্জ্বলতম সূর্য উঠেছিল রাশিয়ায়। দুনিয়ার মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে স্থাপিত হলো পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সেই রৌদ্রকরোজ্জ্বল কাল বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ১৯১৭-তে দুনিয়ার পুঁজিপতিরা ভয়ে কেঁপেছিল। ১৯৯১-এ বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অনুসারীরা হতাশা ও অনিশ্চয়তার গহ্বরে ডুবল। পৃথিবীর সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শ্রমিকরাষ্ট্রটি শ্রমিকশ্রেণির চোখের সামনেই তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল কারও মনে দাগ না কেটে।     

ফুকুয়ামার ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ বইখানা যেন এ ঘটনাবলিরই ইতিকথা। কিন্তু ইতিহাসনাট্যের মাঝপর্বেই শেষ অঙ্ক লেখা হয় কী করে? কেই বা তখন জানত যে, ইতিহাসের সমাধি হয়নি, হয়েছে পচন। ১৯১৭-তে রাশিয়া সমাজতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করতে যেমন ব্যর্থ হলো, ১৯৯১-এ তেমনি ভদ্রসদ্র রকমে পুঁজিবাদকে আলিঙ্গন করতেও ব্যর্থ হলো। রাশিয়ার জন্য দুইই হচ্ছে কল্পরাজ্য- যে ব্যর্থতার দায় পোহাতে হলো ও হচ্ছে দুনিয়ার অনেককে।       

বিখ্যাত কানাডিয়ান দার্শনিক জি এ কোহেন সারাজীবনই ছিলেন সমাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নিয়ে তার স্বপ্নভঙ্গ ঘটল সেভিয়েত রাষ্ট্রের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের আগেই। সোভিয়েতের পতনের ঠিক পূর্বে ১৯৯১-এ নিউ লেফট রিভিউয়ের নভেম্বর/ডিসেম্বর সংখ্যায় মার্ক্সবাদী দার্শনিক কোহেনের একটি লেখা ছিল ‘একটি ভ্রান্তির ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে। এতে তিনি লিখেছিলেন : দেখে মনে হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা এর টুকরোগুলো যেন পুঁজিবাদকে আলিঙ্গন করবে, অথবা একটা জঘন্য একনায়কতন্ত্রের খপ্পরে পড়বে, অথবা এর ভাগ্যে দুইই ঘটবে।

এখন রাশিয়া একটি জঘন্য একনায়কতন্ত্রের খপ্পরেই কেবল পড়েনি, পরিণত হয়েছে খুবই নীচ স্বভাবের একটি যুদ্ধংদেহী দেশে। সোভিয়েত আমলে এটি আফগানিস্তান দখল করেছিল আফগান জনগণকে সমাজতন্ত্রের স্বাদ বোঝানোর অজুহাতে। এবার সে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে দেশটিকে নাৎসিমুক্ত করার ও তার জনগণকে মুক্তির স্বাদ দেওয়ার অজুহাতে। অনুসরণ করেছে ইরাকে মার্কিন হামলার নজিরকে। সেই সঙ্গে ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে লাম্পট্যের কাল- কেবল রাশিয়াতেই না, যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যে ও অন্যান্য দেশেও। 

বিশ্বপুঁজিবাদের সামনে থেকে সমাজতান্ত্রিক লজ্জাশরমের বিঘ্ন সরে যাওয়ার পর অন্যরকম কিছু তো হওয়ার কথাও নয়। যুক্তরাষ্ট্র পেল ট্রাম্পকে, যুক্তরাজ্য জনসনকে, অন্যান্য দেশ পেল খুদে ট্রাম্প ও খুদে পুতিনদের। ফুকুয়ামার প্রিয় পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র নয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে গেল। সোভিয়েত আমলের পুঁজিবাদ সোভিয়েত-উত্তরকালে অশ্লীলরকমের বৈষম্যের সমার্থক, যুদ্ধসিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী ও বিনোদনশিল্পের খপ্পরে, রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজদের বেতনভুক্ত কর্মচারী- আরও অনেক আশ্চর্যরকমের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। উত্তরাধুনিক পুঁজিবাদের লাম্পট্যই আজকের এই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্মদাতা। এই পুঁজিবাদী অভব্যতার সীমা কারা জানও নেই। এ কি ফুকুয়ামার ‘ইতিহাসের সমাপ্তি ও শেষ পুরুষ’, নাকি ইতিহাসের লাম্পট্য ও মানবতার নির্বাসন?    

লক্ষণীয় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটোই ঘটেছিল বিশ্বপুঁজিবাদের মোড়লদের মাঝে। সোভিয়েতের পতন ও সেই ছাই থেকে রাশিয়ার উত্থান হতে না হতেই রাশিয়া ও পশ্চিমা পুঁজিবাদের মাঝে দ্বন্দ্বের শুরু। যা ন্যাটোর সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে। এখন দেখা যাচ্ছে রুশ জাতীয়তাবাদসিক্ত পুঁজিবাদ ও পশ্চিমা আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদের মাঝের দ্বন্দ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বের চেয়ে কম যায় না!   

বিখ্যাত ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সাময়িকীর একটা লেখায় (How Wars Don’t End: Ukraine, Russia, and the Lessons of World War I, by Margaret MacMillam, জুন ১২, ২০২৩) বলা হয়েছে, “আফগানিস্তানে দশ বছরব্যাপী যুদ্ধের চেয়ে রাশিয়া বেশি সৈন্য হারিয়েছে এই যুদ্ধে। লেখক আরও বলেছেন, যদি “ইউক্রেনকে পুনর্নির্মাণের জন্য পশ্চিমাশক্তি কোনো টেকসই উদ্যোগ না নেয়- আর যদি পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে অচ্ছুতের মতো আচরণ করে, তাহলে উভয় দেশেরই ভবিষ্যৎ হবে দুঃখের, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ও প্রতিশোধস্পৃহার।   

তবে রুশ ও পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাঝে কোনো মৌলিক দ্বন্দ্ব আছে মনে করাটা খুবই বোকামি হবে। ‘নোভোয়া গেজেটা ইউরোপে’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি বলেন, “পুতিনের চৌর্যবৃত্তিমূলক (ক্লেপটোক্রেটিক) রাজ্য রাশিয়া ও পশ্চিমের যৌথ উৎপাদিত মাল।” আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মাঝে আজকাল লোকজন যা ভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি মিল আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে ঠিক, কিন্তু একটা সাধারণ মিল হচ্ছে- আমরা বাস করছি এক চরম বৈষম্যের, সম্পদের মালিকদের চরম নিরাপত্তার ও সম্পদহীন লোকজনের চরম নিরাপত্তাহীনতার যুগে।”   

এভাবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সত্য বেরিয়ে আসছে যে, বাইডেনের গণতন্ত্র ও পুতিনের স্বৈরতন্ত্র দুইয়েরই এক গোড়া, দুই ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক। এ হচ্ছে ইতিহাসের সমাপ্তির সমাপ্তি ও এক পুঁজিবাদী লাম্পট্যকালের শুরু। একে প্রতিরোধ করতে হবে বিশ্বের অতিধনিকদেরকে প্রতিহত করে। মার্ক্সের পথে না হলেও, অন্তত পিকেটির দেখানো পথে। সঠিক পথ অনুসন্ধানের জন্য আমাদেরকে ফুকুয়ামার ইতি টানতে হবে, মহান হান্টিংটনেরও।

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //