বঙ্গবন্ধু হত্যা ও দেশী- বিদেশী চক্রান্তের উপাখ্যান

বাঙালি জাতির শোকের মাস আগস্ট। বাংলাদেশের মুক্তির দূত, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির মুক্তির সনদ যিনি এই জাতির জন্য নিজ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দ পরিহার করে নিয়ে এসেছিলেন ত্যাগ আর কষ্টের বিনিময়ে সেই স্বাধীনতার  মহানায়কের জীবননাশ হয়েছিল এ মাসে। তাই আজও ১৫ আগস্ট ফিরে আসে ফি বছর শূন্য হাহাকার বিদীর্ণ আর দুখ ভারাক্রান্ত রূপে। প্রকৃতিও তার বিবর্ণ রূপে ভোরের সূর্যকে স্বাগত জানায় গ্লানি নিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ছিল এ হত্যাকাণ্ড। কারণ যিনি ছিলেন একটি জাতির মুক্তির দূত, যিনি তার পরিবার- পরিজনের জীবনের দিকে না তাকিয়ে স্বীয় মূল্যবান সময়কে সঁপে দিয়েছিলেন অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে, স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন দেশকে, তার‌ই এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে তা ছিল কল্পনাতীত স্বদেশ কিংবা বিদেশের সকলের কাছে । 

ভোর হবার আগেই রক্তে ভেজা দীর্ঘ দেহ পড়ে থাকে নিজ বাসভবনের মেঝেতে। যার স্থান ছিল মানুষের মণিকোঠায়, যাকে সবাই মাথার তাজ বানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছিলেন সে মানুষটাই লুটিয়ে পড়ে ছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে– বিপথগামী সেনাসদস্যের বুলেটের বিদীর্ণ আঘাতে! 

কিন্তু হত্যার এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে আসলে কে বা কারা ছিলেন সে বিষয়ে যুগের পর যুগ হয়েছে আলোচনা। দেশি নাকি বিদেশি এমন হাজারও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দিস্তা দিস্তা কাগজে লিপিবদ্ধ হয়েছে নানা কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণা পত্র। প্রথিতথযশা লেখক- গবেষকরা লিখেছেন জাতির পিতা হত্যার নেপথ্যের ষড়যন্ত্রের নীল নকশার নানা ঘটনা। এ লেখাটি মূলত বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নানা লেখনী ও তথ্যের সমন্বয়ের প্রয়াস। 

ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম এক কলামে এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দেশীয় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বিদেশী বা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তার সেই লেখা থেকে বেশ কিছু অংশ তুলে ধরা হলো -  

‘‘১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু দেশীয় ষড়যন্ত্রের ফসল ছিলো না; এর সাথে জড়িত ছিলো একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র; যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ছিলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, বিশেষ করে হেনরি কিসিঞ্জারের একটি বড় পরাজয়, ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের জন্য চপেটাঘাত। তারা এ পরাজয়ের প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিলেন। তখন চলছিলো স্নায়ুযুদ্ধ, বিশ্ব ছিলো দুইভাগে বিভক্ত। একভাগে ছিলো আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক। আরেকভাগে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক। বাংলাদেশ ছিলো জোটনিরপেক্ষ গ্রুপে, তবে সোভিয়েত ঘেঁষা। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিলো অনন্য। ভারতও ছিলো সোভিয়েত ঘেঁষা। দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বামদের একচ্ছত্র প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য ছিলো না। এজন্য মার্কিন প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর ওপর ছিলো চরম ক্ষ্যাপা। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছিলো একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তারা ১৯৭২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান তাঁর ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মেজর ফারুক, রশিদ ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের অগোচরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যান অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা করতে। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই সরকারকে না জানিয়ে মেজর ফারুকের ভায়রা ভাই মেজর আবদুর রশিদ অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যান।‘’ 

তাহলে আপাত দৃষ্টিতে এটা প্রতীয়মান, এ ষড়যন্ত্রের পেছনে মার্কিন দূতাবাসের একটি বড় ভূমিকা ছিল। আর নয়ত কেনইবা সে সময়ে ফারুক মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে।  

তার লেখার আরেক অংশে তিনি জানাচ্ছেন- ‘’১৯৭৪ সালের ১৩ মে মেজর ফারুক মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সরাসরি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান। একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বলে বেড়ায়, বাকশাল গঠন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ক্ষেত্র। তাই যদি হয়, তাহলে ঘাতকরা ১৯৭২, ৭৩, ৭৪ সালে কেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা করলো? তখন তো বাকশাল ছিল না।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএ জড়িত ছিলো। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ তার প্রণীত গ্রন্থ ‘Bangladesh : The Unfinished Revolution’ এ শেখ মুজিব হত্যায় সিআইএ এর জড়িত থাকার কথা বলেন। মার্কিন আরেক সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্স তার ‘The Trial of Henry Kissinger’ গ্রন্থে লরেন্স লিফশুলজের বরাত দিয়ে মুজিব হত্যাকাণ্ডে সিআইএ এর জড়িত থাকার বিষয়টি সমর্থন করেন। তিনি তার এ গ্রন্থে নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে বসেই ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘এগিয়ে যাও' সিগন্যাল দেন। এছাড়া তিনি কিসিঞ্জারকে একজন অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বিচিত্র মিথ্যাবাদী ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ২০০১ সালের মার্চে ‘হারপারস’ নামক এক ম্যাগাজিনে এবিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেন।‘’ 

আরেকটা বিষয় উঠে এলো যে, তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ঘটনার নেপথ্যের এক পরামর্শদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

‘হারপারস’ ম্যাগাজিনে লরেন্স লিফশুলজের সে লেখায় ছিল - ‘’বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কিসিঞ্জার রাজনীতির বিষয়টাকে একটি নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ ব্যাপার হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা দেখিয়েছেন। তার কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তার জন্য অসুবিধাজনক কতিপয় ব্যক্তির কথাও আমরা জানি। যাদের মধ্যে রয়েছেন সালভাদর আলেন্দে, আর্চ বিশপ ম্যাকারিওস ও শেখ মুজিবুর রহমান।”

তৎকালীন সময়ে হ্যারল্ড স্যান্ডার্স ছিলেন দূরপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ওয়াশিংটনের সময় সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। স্যান্ডার্স কিসিঞ্জারকে সেদিন বলেন, “ঢাকা থেকে একটা বার্তা পেলাম। ঢাকার মোশতাক সরকার আমাদের স্বীকৃতি ও নৈতিক সমর্থন চাইছে। আমরা কি একটা বন্ধুত্বপূর্ণ উত্তর দিতে পারি?” জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, “আমরা মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে ধন্য মনে করছি। বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে বার্তা পৌঁছে দাও, যাতে তারা ভরসা পায় যে, আমরা তাদের চাহিদার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবো।” তাহলে এরপরে মনে হয় কিসিঞ্জারের বক্তব্য হতে আরেকটু স্পষ্ট হওয়া যাচ্ছে যে, মার্কিন প্রশাসন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলো।

বিবিসি'র সৈয়দ মাহমুদ আলির ‘Understanding Bangladesh’ গ্রন্থেও এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পূর্ব পরিকল্পনা ঠিক কীভাবে নেয়া হচ্ছিল সে বিষয়ে অনেক তথ্যই লিপিবদ্ধ ছিল।  

অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের একটি লেখায় দু’জন মূল ষড়যন্ত্রকারী কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদ একটি বৃটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রদানের বিষয়টি তুলে ধরেন। সেই  সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন লন্ডনের ‘Daily Observer’ পত্রিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস। সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারেও হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে তাদের ষড়যন্ত্রের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায় তাদেরকে। ওই  সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য ও বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আর সেই সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িতের বিষয়টি তুলে ধরেন ফারুক ও রশিদ। 

নেপথ্য এ ষড়যন্ত্রের এক মহা খলনায়কের নাম খন্দকার মোশতাক আহমেদ। 

বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করলে তাকে  গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পৈতৃক বাড়িতে দাফন করা হয়। সেসময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সামরিক-বেসামরিক অফিসার ও গণ্যমান্য ব্যক্তি লাশ দাফনের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক‌ও সে কাজে অংশ নিতে উপস্থিত ছিলেন, সে সময় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী। শেখ লুৎফর রহমানের লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে যখন কবরে নামানো হয়, তখন খন্দকার মোশতাক কবরে নেমে এমন কান্নার স্রোত বইয়ে দিচ্ছিলেন যেন শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে তাকেও দাফন করা হয়। কোনোভাবেই কবর থেকে আর ওঠানো যাচ্ছিল না তাকে। তখন বঙ্গবন্ধু তাকে ধমকের সুরে বলেছিলেন, “ঐ মোশতাক, বাপ মরেছে আমার, তুই এমন পাগলামি করছিস কেন? কবর থেকে উঠ, দাফনের কাজ সম্পূর্ণ করতে দে।” (রেজাউল করিম, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা, গ্রন্থকুটির প্রকাশনা।) 

অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই ব্যক্তিই তখন গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের আরেক কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। 

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি হয়ে হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ঘোষণা তিনিই দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতা (তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান) কে ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ হত্যার অনুমতিও তার কণ্ঠেই পাওয়া গিয়েছিল। 

১৯৭৫ পরবর্তী কিছু নিবন্ধের লেখা থেকে আমরা ঘুরে আসি। 

১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি  ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ‘Bangladesh Execution : A Discrepancy’ শিরোনামে একটি নিবন্ধমতে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ‘আগের বছরের ২ অক্টোবর এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঘটনায় ২১৭ জনের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আলফ-ই-বার্গেসেন এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে একটি গোপন বার্তা পাঠান। কিন্তু পররাষ্ট্র দফতরের সূত্র এটি মিডিয়ায় ফাঁস করে দেয়। এ বার্তা থেকে জানা যায় যে, ২১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার মধ্যে প্রায় ৩০-৩৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পূর্বেই। এ গণপ্রাণদণ্ডের চার মাস পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন ‘Human Rights Watch’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। ১৯৭৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি  তারিখে ‘বাংলাদেশ টাইমস’ পত্রিকায় মানবাধিকারের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। 

এতে করে বেশ প্রতীয়মান যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তাদের মতাদর্শের সঙ্গে যাদের একাত্মতার কোনো সূত্র পেয়েছে কেবল তাদের জন্যই সকল নিয়ম পরিবর্তন করে নিমিষেই খলনায়ককে নায়ক বানিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। নিজ স্বার্থে সবটাই করার মত মানসিকতা ধারণ করে থাকে তারা। 

১৯৭৮ সালের ২৫ মার্চ এন এম জে ছদ্মনামে লিফশুলজ ‘Economic and Political Weekly’ পত্রিকায় তার লেখা এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৭৬ সালের বৈদেশিক নিরাপত্তা সহায়ক আইন যা ৫০২-বি হিসেবে পরিচিত সম্পর্কে লিখেন। সেখানে তিনি আইনটির সংশোধনীর বিষয় উল্লেখ করেন। মূলত এ আইনের আওতায় বাংলাদেশকে সামরিক সহায়তা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই হত্যাকারীরা যেভাবে সহজে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে আশ্রয় পেল তাতে প্রমাণিত হয় যুক্তরাষ্ট্র এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সিরিয়া থেকে শুরু করে কিউবা এমন অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোপন নানা ষড়যন্ত্র চালিয়েছে শুধুমাত্র তাদের মতাদর্শের সরকার বা প্রশাসন কিংবা তার নিজ দেশের স্বার্থ আদায়ের পথকে কণ্টকবিহীন করতে। 

ইতিহাস বলছে, সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দেশটি যখন থেকে পৃথিবীতে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের বিশাল কর্মযজ্ঞের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিল, তখন থেকেই যেসব শাসক যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হবে না, তাদের স্বার্থে কাজ করবে না- তেমন জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক শাসককে উৎখাতসহ হত্যা করতে বা করাতে কিংবা হত্যার প্ররোচনা দিতে তাদের ছিল না কোনো দ্বিধা। 

চিলির আলেন্দে, ঘানার ড. কাউয়ামে নক্রুমা, গুয়াতেমালার জ্যাকোবা অরবেঞ্জ, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুলুম্বা, নাইজেরিয়ার আবু বকর তাওয়াফা বলেওয়া, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফিসহ এমন অসংখ্য বিশ্ববরেণ্য জনপ্রিয় নেতাদের হত্যার মাধ্যমে উৎখাতে তারা দ্বিধা করেনি। কারণ তারা ছিলেন বাম ঘরানার জাতীয়তাবাদী শাসক। আমেরিকার ইতিহাসে ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুধু ছিল কিউবার ফিডেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে না পারার গ্লানি। যদিও তাকে হত্যা করতে কম চেষ্টা ছিল না তাদের। 

বলা যায় মূলত বাংলাদেশের মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে মার্কিনিরা চায়নি পাকিস্তান থেকেও দেশটি স্বাধীন হোক। উপমহাদেশকে অভিজ্ঞ রাজনীতিক শূন্য করে নিজেদের পররাষ্ট্র নীতি কায়েম করতেই যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পেছনে ইন্ধন দিয়েছে বলে দাবি করেন ভারতের সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।

কলকাতায় সময় টেলিভিশনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ দাবি করেন 'মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা'র লেখক সুখরঞ্জন। হত্যার বিষয়ে সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে ষড়যন্ত্রের জাল তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে। পৃথিবীর বুকে লাল-সবুজের পতাকা একদিন বাঙালির গর্বের প্রতীক হবে– সেটা বুঝে গিয়েছিল বিশ্ব মোড়লদের কেউ কেউ। তাই পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায়; নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার সুফল তুলতে পেছন থেকে পাকপন্থী সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি সেনা ও ক্ষমতালোভীদের "পাপেট" বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর বুকে বুলেট বিদ্ধের নকশা হয়।’

ওই সাক্ষাৎকারে সুখরঞ্জন বলেন, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। বারবার তারা যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে।?’

বর্ষিয়ান এ সাংবাদিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সাহায্য করেছে ভারত। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পক্ষে বিশ্বের একমাত্র দূত। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সামনে পশ্চিমা কূটনীতির চাল ধরাশায়ী হয়ে পড়বে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের মতো রাজনীতিক থাকলে এ অঞ্চলে মার্কিনিদের প্রভাব বলয় তৈরি চাপের মুখে পড়ত। তাই সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা করেই উপমহাদেশ থেকে দুই রাজনীতিককে সরিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে ইতিহাসবেত্তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য চীনপন্থি বামপন্থি বেশ কিছু দলও তৎকালীন সময়ে জড়িত ছিল। আর এখান থেকেই সেনাদের পাশাপাশি দেশীয় রাজনীতিবিদদের আরেকটা বড় অংশ ভিন্ন আঙ্গিক থেকে এই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছিল সেই সময়। কৃষক শ্রমিকের কথিত রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে দেশে হত্যা-খুন, ডাকাতি, লুটতরাজের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটিয়ে মুজিব সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অগ্রণী ভূমিকা পালনে তারা তৎপর ছিল। বঙ্গবন্ধুকে অজনপ্রিয় করতে এবং তাকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতে প্রয়োজনীয় উপাদানের যোগান দিয়ে আসছিল এইসব দল‌গুলো। 

তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা  ‘কেজিবি’ ও ভারতের ‘র’ এর তরফ থেকে জানানো হয়েছিলো। এমনকি ৩২ নম্বরের বাসভবন ছেড়ে বঙ্গভবন বা গণভবনে ওঠার অনুরোধও করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির পিতা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। হিমালয়সম আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এদেশের মানুষ আমাকে মারবে কেন? আমি আমার দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তারাও আমায় ভালোবাসে।” 

সেনাবাহিনীর বিপথগামী যেসব সদস্য সেদিনের এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড  ঘটিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন লেঃ কর্নেল ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, মেজর বজলুল হুদা, মেজর নুর চৌধুরী, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর রাশেদ চৌধুরী, লেঃ খায়রুজ্জামান, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন প্রমুখ।

খুনিদের বিচার বন্ধ করতে খন্দকার মোশতাক দায়মুক্তি (Indemnity) অধ্যাদেশ জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সে অধ্যাদেশকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি রূপ দেন। 

লেখক রেজা সেলিমের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘তৎকালীন সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী অন্তত সাতটি তারবার্তা পাঠান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। ১৬ আগস্ট এ সম্পর্কে প্রাথমিক মন্তব্য শীর্ষক বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৫ আগস্ট স্থানীয় সময় ভোর সোয়া পাঁচটায় অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পরের ঘটনা এই আশাবাদ সৃষ্টি করেছে যে এ অভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ করা হবে না।’

তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকার খবর জানতে উদ্‌গ্রীব ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার প্রায় ১১-১২ ঘণ্টা পর তিনি তার স্টাফ বৈঠকে উল্লেখ করেন, ‘আমি আইএনআর (ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ) থেকে এ বিষয়ে ভালো তথ্য পাই।’ এ সময় ব্যুরোর পরিচালক উইলিয়াম জি হিল্যান্ড বলেন, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলি, মুজিব তখনো মারা যাননি।’ সিআইএর সাবেক এই চৌকস কর্মকর্তা হিল্যান্ডের মৃত্যুর পর হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, ‘তিনি ছিলেন এক ভাল বিশ্লেষক। আমাদের গ্রুপে তিনি ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৮ মার্চ ২০০৮)। 

তবে ১৫ আগস্ট কিসিঞ্জার কিন্তু তার সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সম্পর্কে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেছিলেন, ‘তার মানে কী? মুজিবুর কি জীবিত, না মৃত?’ নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড আথারটন এ সময় বলেন, ‘মুজিবুর নিহত। তার নিকটতম আত্মীয়স্বজন, যাদের অধিকাংশই পরিবারের সদস্য, তারা বেঁচে নেই।’

এ-সংক্রান্ত দলিল থেকে স্পষ্টত হার্ভার্ড হতে স্নাতকোত্তর ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আথারটন এবং ১৯৬৯ পর্যন্ত সিআইএ’তে কর্মরত হিল্যান্ড বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানের খুঁটিনাটি জানতেন। ১৯৬২-৬৫ সালে কলকাতায় কর্মরত আথারটন ২০০২ সালের ৩০ অক্টোবর মারা গেছেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি মিসরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অন্যদিকে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ হিল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

সে সময়ের বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন অ্যাম্বাসেডর যার কথা ওপরে উল্লেখিত আছে তিনি সে সময় পাঠানো তারবার্তাগুলোয় বিভিন্নভাবে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান যাতে নির্বিঘ্নে সংঘটিত হতে পারে সে বিষয়ে সংবেদনশীল ও সতর্ক ছিলেন বলে কলামিস্টদের লেখায় আমরা দেখতে পাই। 

এ বিষয়ে রেজা সেলিমের নিবন্ধে পাওয়া যায়- বোস্টার ১৬ আগস্ট লিখেন, ‘জনসাধারণ যদিও মুজিবের পতনে আনন্দ প্রকাশ করেনি কিন্তু গ্রহণসূচক শান্ত অবস্থা বজায় রয়েছে এবং সম্ভবত তাতে স্বস্তির নিশ্বাসও রয়েছে। শেখ মুজিব ও বাঙালিরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে তার ব্যর্থতা। এবং দৃশ্যত তার ক্ষমতায় থাকাটা হয়ে পড়েছিল মূলত ব্যক্তিগত ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয় “ডাইন্যাস্টিক রিজনস” অর্থাৎ রাজবংশীয় শাসকদের পরম্পরাসংক্রান্ত কারণ। বাঙালিদের কাছ থেকে মুজিবের বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বাড়ার বড় কারণ ছিল তিনি যথাযথ পরামর্শ গ্রহণ থেকে দূরে সরছিলেন। এমনকি মুজিবের মধ্যে স্বৈরশাসকের চিরায়ত বৈকল্য ফুটে উঠতে শুরু করেছিল।’ 

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে কিনা এ প্রসঙ্গে  বোস্টার লিখেন, ‘নতুন সরকারের সঙ্গে আমাদের নিজেদের সম্পর্ক মুজিব সরকারের চেয়ে “এমনকি আরও অন্তরঙ্গ ভিত্তি”র ওপর প্রতিষ্ঠা পাবে। নতুন রাষ্ট্রপতি অতীতে অত্যন্ত লক্ষণীয় ও প্রকাশ্যে “প্রো–আমেরিকান” দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বড় কথা হচ্ছে, মুজিব সরকারের মধ্যে শেখ মনি ও সামাদের (আবদুস সামাদ আজাদ) মতো যাঁরা বামপন্থী ও আমেরিকাবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারা আর নেই।’

অন্যদিকে মোশতাক সরকার এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে কেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারে সেটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইউজিন বোস্টার উল্লেখ করেন, ‘এটা আমরা বিচার করতে পারি না। আমরা কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করি যে প্রত্যেক সরকারি বিবৃতিতে ক্ষমতা গ্রহণের অনুকূলে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হচ্ছে। আমাদের বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী বর্তমানে সামরিক আইন আদেশ এমএলও প্রস্তুত করছে এবং এ ক্ষেত্রে যদি পাকিস্তানি ধাঁচ অনুসরণ করা হয়, তবে তা-ই হবে দেশের আইনের ভিত্তি। ’

বোস্টার এ পর্যায়ে আরও উল্লেখ করেন, ‘মুজিবকে উৎখাতে সামরিক বাহিনীর সাফল্যের প্রেক্ষাপটে আমাদের এই ধারণা জন্মেছে যে অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি। যাহোক, সামরিক বাহিনী—বিশেষ করে যেসব তরুণ কর্মকর্তা, যারা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাই শেখ মুজিবকে উৎখাত করেছেন এবং আমরা সন্দেহ করি এবং যেহেতু তারা রক্তের স্বাদ পেয়েছেন, তখন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তারা কিছু ভূমিকা রাখতে চাইবেন। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে কোনো বাঙালি গাদ্দাফিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। তার চেয়ে বরং এটা ভাবাই সংগত যে চাকরিমুখো মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরোনো সদস্য—যারা শেখ মুজিব দ্বারা হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা হয়তো একটি অধিকতর উদারপন্থী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। পাকিস্তানি জমানায় পূর্ব বাংলায় যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তার চেয়ে এটা হতে পারে ভিন্ন।’

রেজা সেলিম তার কলামে লিখেন, একটি বিষয় লক্ষণীয় এ হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতা থেকে এটা বেশ প্রমাণিত যে, এ ঘটনার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রতিশোধস্পৃহা। সে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল একাধারে রাজনৈতিক-ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তার দিক-নির্দেশক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনের সবরকম উদ্যোগের বিরুদ্ধে।

অবসরপ্রাপ্ত এক বয়োজ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি যিনি পরে ভার্জিনিয়ায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর ফরেন অ্যাফেয়ার্স ওরাল হিস্ট্রি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন; তিনি ১৯৮৯ সালের ২০ অক্টোবর ৭৪-৭৬ সালে বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারের একটি সাক্ষাৎকার নেন। 

ওই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বোস্টার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেছেন- “তিনি ছিলেন খুবই এক ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব, দুর্দান্ত মানুষ। আপনি কেবল এই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই তাঁকে পছন্দ করবেন।”

এমনকি বঙ্গবন্ধুর জীবন-যাপন সম্পর্কেও বোস্টার উল্লেখ করেন তার সব প্রশংসনীয় মত- “যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন সেটি ছিল খুব সাধারণ একটি বাড়ি, কোন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির বসবাসের জন্যে যথাযথ নয়। কিন্তু তিনি দেশের পিতার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছিলেন অনেকটা জর্জ ওয়াশিংটনের মতো, যিনি তার দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন তবে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা তার তেমন ছিল না!” বোস্টারের মতে- “শেখ মুজিবের চেয়ে জিয়া প্রশাসক হিসেবে দক্ষ বলে বলে তার কাছে মনে হয়েছে ও সেরকম কাউকেই তখন দরকার ছিল।” (Someone with more managerial talent was required. They had that talent in Zia who eventually succeeded him)!’’

আর এটাই ছিল ‘মুখে এক মনে আর এক’ এ বাক্যের সত্যতা বহনকারী হিসেবে তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিক বোস্টারের উদাহরণ সহজেই চলে আসে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাতে (৫ অগাস্ট ১৯৭৫) দুজনই দেশ পরিচালনা, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা সবই আলোচিত হয়েছিল ও পরদিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার যে তারবার্তায় এই সাক্ষাতের প্রতিবেদন ওয়াশিংটনে পাঠান সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এরকম প্রশংসা করে বিস্তর স্তুতিবাক্য লিখেছিলেন। 

কিন্তু তিনি সেই প্রতিবেদনে এটাও লিখতে ভোলেননি যে, বঙ্গবন্ধু তাকে তার রাষ্ট্রচিন্তার যে দর্শন ব্যাখ্যা করেছিলেন তাতে মার্কিন সরকারের বিচলিত হবার যথেষ্ট কারণ আছ-

“I am not a Marxist. I am a Socialist, but a Socialist in my own way. I want to be friends with all countries but I don’t want any country to think it can tell me what to do”

আর বঙ্গবন্ধুর এমন অকুতোভয় কথাগুলো সেদিন মার্কিন প্রশাসনকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। এর সঙ্গে ওই প্রতিবেদনের শেষে সারমর্মে বোস্টার লিখেন- “His repetiation of the theme that he is not a Masrxist, his insistance thay no other power can tell him what to do, and his volunteered criticism of communist China’s farm system all seem intended to ease our minds about the political direction he is taking.”

ঠিক বঙ্গবন্ধু হত্যার আগের ও পরের তারবার্তা মিলিয়ে দেখলে পাওয়া যায় মার্কিন নীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুবিরোধী নীতির প্রভাব কতটা প্রবল ছিল যা ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের নীতির পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার বাসনাকে বেশ বেগবান করেছিল। 

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে ‘The U.S. Must Extradite My Grandfather’s Killer’ শীর্ষক একটি কলামে খুনি রাশেদ চৌধুরী সম্পর্কে লিখেন, ‘‘ More than 40 years later, one of my family’s assassins, Rashed Chowdhury, lives at liberty in the United States. He was fairly tried in open court in Dhaka and convicted in absentia on charges of murder and conspiracy to commit murder, even though his former military rank as a lieutenant colonel would have allowed for a court-martial, a far quicker and less transparent process.’’

তিনি আরও উল্লেখ করেন,‘‘In 1998, 15 former military officers were convicted of the assassinations. Appeals and further process followed, but finally, in 2009, Bangladesh’s Supreme Court delivered a measure of justice the nation had long craved by upholding the convictions of five of the assassins. The saga did not end there.

In 1996, before the trials started, Mr. Chowdhury joined several other conspirators in fleeing Bangladesh. He applied for asylum in San Francisco, but his current immigration status is unclear. Since then, he has reportedly lived in Los Angeles and Chicago. Despite the efforts of the Bangladesh government, Mr. Chowdhury remains hiding in plain sight; the American government should stop sheltering him.

If Mr. Chowdhury is extradited to Bangladesh, he will face a death sentence. Like the United States, Bangladesh allows the death penalty for high crimes like treason, terrorism and federal murder.’’

কলামের শেষ প্যারায় জয় লিখেন,’’To the best of our knowledge, Mr. Chowdhury has not been granted refugee status; therefore, he is not immune from extradition proceedings. There are no grounds for further delay in extraditing him. The United States should respond to Bangladesh’s repeated pleas to conclude the matter, so that justice may be done.’’

বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে আরেক বিখ্যাত বর্ষীয়ান সাংবাদিক মার্ক টালি সিআরআই আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে এটিকে আরেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। 

তিনি ওই ওয়েবিনারে উল্লেখ করেন,"India was very unhappy with the assassination of Sheikh Mujibur Rahman and his family members, and relations nosedived sharply. But with his party and daughter back in power, relations with India have improved sharply. There are problems and there will be problems but the relations are basically very good," 

এসময় তিনি আরও বলেন, ‘’There were different streams – one stream was pro-Western economic way, anti-socialist, anti-Indian, and also there was a… what I may call…… an Islamic stream as well, the movement for Bangladesh started immediately after the birth of Pakistan."

উপরের সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে একটা বিষয় বেশ জোরালোভাবেই সকল কলামলেখকরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই বলি না কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় এক ভূমিকা ছিল পর্দার আড়াল থেকে। যে কথাটি সপষ্ট করতেই উপরোল্লিখিত কলাম লেখক, বিদেশী সাংবাদিকদের নানা নিবন্ধ ও মন্তব্যের মধ্যদিয়ে তারা তাদের মত প্রকাশ করেছেন।

একটি সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠিত করতে দরকার হয় যোগ্য একজন নেতার। যার সবটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। রাষ্ট্র পরিচালনায় দাসত্ব কিংবা প্রভূপ্রথা মেনে নেয়ার লাল খাতায় দস্তখত করার মত ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন না এই সূর্য সন্তান আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। কেননা বিদেশী অন্যতম ক্ষমতাধরেরা কোনভাবেই এমন অবিচল, হিমালয়সম, পূর্ণ স্বাধীনচেতা মনোভাবের অধিকারী নেতৃত্ব দেখতে ছিল না প্রস্তত। এর সঙ্গে দেশীয় কিছু ব্যক্তি,গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটাতে হয়ে ওঠে মরিয়া। দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে  এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে আরেকটা পলাশী বিপ্লবের গোড়াপত্তনের স্বপ্নে লালায়িত হয়ে পড়ে। যার বলিদান বাঙালী জাতিসত্তার অভিভাবক, আলোকবর্তিকা ও পথপ্রদর্শকের চিরবিদায়। পরিণতিতে শেষ স্বাধীন নবাব যেমন স্বাধীন পলাশীর শেষ সূর্যাস্ত দেখেছিলেন অনুরূপ এদেশের মানুষও সেদিন স্বাধীনতা পেয়েও এর স্বাদ গ্রহণের আগেই একটি পথহারা জাতিতে পরিণত হয়েছিল। 

তথ্যসূত্র:

• বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য ষড়যন্ত্র-রেজাউল করিম

• The U.S. Must Extradite My Grandfather’s Killer-  Sajeeb Wazed, Nov. 7, 2016, The New York Times 

• দলিল থেকে: ‘অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি’-মিজানুর রহমান খান, প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, প্রথম আলো 

• কলকাতায় সময় টেলিভিশনকে দেয়া 'মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা'র লেখক ও ভারতের সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার ।  

• সময় টিভি কলকাতাকে দেয়া ভারতীয় সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার 

• Bangabandhu’s Assassination: Former BBC veteran hints about int'l conspiracies,Published in Business Standard, 18 August,2021

• মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের ‘Bangladesh : ‘The Unfinished Revolution’ ও  ‘The Trial of Henry Kissinger’ এর কিছু উদ্ধৃতি 








সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //