বঙ্গবন্ধু: বাঙালি জাতির কল্যাণের সংহিতা

১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ। পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এক শিশু, যিনি পরে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা হন; যার চরিত্রের মাহাত্ম্য, আত্মত্যাগের মানসিকতা, পরিশ্রম করার অতিমানবীয় শক্তি এবং কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে জেগে ওঠে এ দেশের প্রতিটি মানুষ, বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতা ও দাস্যবৃত্তির কালিমালিপ্ত ইতিহাসকে মুছে দিয়ে যিনি অভ্যুদয় ঘটান স্বাধীনতার লাল সূর্য। এবং ‘খোকা’ থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘মিয়া ভাই’, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরও পরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারটির দিকে তাকালে, যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন, পরিবারটি ধারণ করেছে চিরকালের বাঙালি জাতির সর্বাবয়ব। পরিবারটি ধর্মপ্রাণ, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। অর্থ-ঐশ^র্যে বনেদি কিন্তু তার ক্রমিক অবনমনের পরও মর্যাদাসম্পন্ন এবং উদার ও দানশীল ও ব্রিটিশবিরোধী ভাবাপন্ন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এই গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর তারই সুযোগ্য উত্তরাধিকার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, যার শৈশব স্মৃতির সবই গ্রামকেন্দ্রিক। তিনি লিখেছেন: ডাল ঝাঁকিয়ে বরই পেড়ে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। গ্রামের বড় তালাবের (পুকুর) পাড়ে ছিল বিরাট এক বরই গাছ। ঝাঁকুনির ফলে লালের আভা লাগা সব থেকে টসটসে বরইটা পুকুরের গভীর পানিতে গিয়ে পড়ত এবং কারও পক্ষে কিছুতেই সেটা যখন তুলে আনা সম্ভব হতো না, তখন সেই বরইটার জন্য মন জুড়ে থাকা দুঃখটুকু এখনো ভুলতে পারলাম কই? [শেখ মুজিব আমার পিতা, ২০১৭ : ৫৭]

এই বোধটুকু হৃদয়স্পর্শী, মহার্ঘ। খুব মনে হয়, আমাদের নগর-সভ্যতার যা কিছু মহত্তর তার সবটুকুই যেন এসেছে ওই গ্রামীণ সংস্কৃতির চিরকালের ঐতিহ্য থেকে, বোধ থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ওই ঐতিহ্যের নিরন্তর উত্তরসাধক এবং অনন্তকালের জন্য তিনি ওই গ্রামে নিয়েছেন শেষ আশ্রয়।

খুব ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গ্রামের আর দশটি শিশুর মতোই দুরন্ত। কিন্তু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে তার দয়ার্দ্র হৃদয় করুণায় মথিত হয়ে উঠত। শীতার্ত কোনো বৃদ্ধকে তিনি দিয়ে আসতেন নিজের গায়ের গরম চাদর, ছিন্নবস্ত্র কাউকে দেখলে নিজের পরনের শার্ট দিয়ে চলে আসতেন বাড়িতে। বছরে অনেকগুলো ছাতা কিনতে হতো তার জন্য। কারণ তিনি রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পাওয়া কোনো সহপাঠীকে ছাতা দিয়ে চলে আসতেন। হতদরিদ্র মানুষের জন্য পিতার ধান-চালের গোলাঘর খুলে দেওয়ার নজিরও আছে তার। 

যখন সামান্য বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই তার চরিত্রের মধ্যে রাজনীতিমনস্কতা লক্ষ করা যায়। যখন তার বয়স ১৬ বছর, সেই সময় থেকেই তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আসেন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিবের ওপর। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। একসময় তিনি লক্ষ করেন যে, হিন্দু ছেলেরা সরে পড়ছে। কারণও জানলেন। কংগ্রেসের নেতারা তাদেরকে ওই সম্মেলন বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই প্রথম ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে এবং কৈশোরেই তিনি হাড়ে হাড়ে টের পান যে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার রূপ কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং এক জীবন তিনি অসাম্প্রদায়িক জীবনাদর্শকে লালন করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই জীবনাদর্শকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

এই সম্মেলনেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ মহাত্মা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর হিসেবেই শুধু নয়, অধিকন্তু তার সাহসিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সর্বোপরি মানুষের প্রতি ভালোবাসা রাজনীতির মঞ্চে তাকে বিপুল জনপ্রিয় করে তোলে। ইসলামিয়া কলেজের রাজনীতিতে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর এ সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কতটা ভয়াবহ হতে পারে দ্বিতীয় বার তারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেন এই কলকাতা জীবনে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বিপুল প্রস্তুতি বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার পাকিস্তান শাসিত রাজনীতিতে তাকে যোগ্যতর করে তোলে। ফলে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতেও তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অবিসংবাদিত রাজনীতিক হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান আন্দোলনের তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের চেতন-অবচেতনের মধ্যে একটি স্বপ্ন প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। আর তা হলো স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। বিভাগপূর্বকালেই ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওই উদ্যোগ বাস্তবায়িত না হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ওই আন্দোলন থেকেই।

পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীকে তাদের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেই থামেনি, বাংলা ভাষা ও তার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হানে। শেখ মুজিবুর রহমান মূলত বাংলা ভাষার অধিকারের প্রশ্নে যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো ইস্যু হতে পারে না। অসামান্য দূরদর্শিতার গুণে তিনি স্পষ্টভাবেই অনুধাবন করেছিলেন, বিচিত্র ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও পেশার এই বঙ্গভূমির জনসাধারণকে একত্রিত করার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো বিষয় নেই। সুতরাং সময়ের অসাধারণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি যথার্থভাবেই দেশভাগের অব্যবহিত পরে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন। আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সেই পথ ধরে তার নেতৃত্বে ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল জয়, ৬২-র গণজাগরণ, ৬৫ সালের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ৭০-এর নির্বাচন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনের আত্মবিসর্জনের পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

একটি আধুনিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি ৭২-এর সংবিধানের মূল ভিত্তি করেছিলেন চারটি স্তম্ভকে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এই মূলনীতির আলোকে বাংলাদেশকে বিশ^দরবারে আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, যার মর্মার্থ হলো : দুর্নীতির মূলোৎপাটন, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।

একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে তিনি সবাইকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন এবং সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সর্বতোমুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ৭১-এর পরাজিত দেশি-বিদেশি অপশক্তি তা মেনে নিতে পারেনি। তারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। তার রাষ্ট্রভাবনা ও জীবনাদর্শের চিহ্নমাত্রও যাতে অবশিষ্ট না থাকে সেজন্য রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রবহীন শিশু রাসেলসহ পরিবারের সকল সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, তার সমাধিস্থলকে কেন্দ্র করে তার আদর্শ ও চেতনায় কোটি মানুষের উদ্বোধন এবং আন্দোলন রহিত করার জন্য ঘাতকরা তার মরদেহ সমাহিত করে ঢাকা থেকে বহু দূরে অবস্থিত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। কিন্তু সত্য ও সুন্দরকে কখনোই হত্যা করা যায় না। দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ-বঞ্চনামুক্ত যে সমৃদ্ধ ও আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সেই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়প্রত্যয়ে।

কন্যার ভালোবাসা ও সেবা-শুশ্রƒষায় বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শেষ দিনগুলো নির্জন-নিভৃত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে অতিবাহিত করতে চেয়েছিলেন। বাঙালি জাতির মহান নেতা এই টুঙ্গিপাড়াতেই পিতা-মাতার পাশে চিরনিদ্রায় সমাহিত হয়ে আছেন। আজ টুঙ্গিপাড়া কোনো গ্রাম নয়- বাঙালি জাতির চেতনার তীর্থভূমি। তার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা হৃদয়ের সকল আকুলতা নিয়ে পিতাকে খুঁজছেন চিরকালের ওই প্রকৃতির মাহাত্ম্য ও বিশালতার মধ্যে :

এক টুকরো সাদা মেঘ ভেসে যাবে
ওখানে কি তুমি?
আকাশে বাতাসে পাহাড়ে উপত্যকায় 
তোমাকে খুঁজবো, ডাকবো
  যে প্রতিধ্বনি হবে
ওখানে কি তুমি?
শুভ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন।
  [‘বাবা’, শেখ রেহানা] 

নিরন্তর ওই অন্বেষণের সঙ্গে চিরকাল ধরে এই পুণ্যভূমি থেকে নির্দেশিত হবে বাঙালি জাতির কল্যাণের সংহিতা। এখান থেকে আলো নিয়ে পথ চলবে অনন্ত কালের বাঙালি। কেননা তিনি আমাদের স্বপ্ন রচয়িতা এবং আমাদের স্বপ্নের চেয়ে বড়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //