পুলিশ কখন ভোট চায়

গণশুনানিতে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে একজন ওসি যেদিন ‘হাইকোর্ট দেখালেন’- তার দুদিন পর আরেকজন ওসির একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পক্ষে ভোট চাইছেন। যদিও কোনো প্রার্থীর পক্ষে পুলিশের ভোট চাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক গণশুনানিতে প্রতিমন্ত্রী পলককে ‘হাইকোর্ট দেখানো’ ওসিকে নিয়ে কী হয়েছে। 

গত ১৩ আগস্ট নাটোরের সিংড়া উপজেলায় চুরি, ছিনতাই ও মাদকসংক্রান্ত বিষয়ে গণশুনানি হয়। এতে স্থানীয় একজন বাসিন্দা তার জমি দখলের বিষয়ে থানায় অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার না পাওয়ার কথা জানালে প্রতিমন্ত্রী পলক ওসি মিজানুরকে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় ওসি মিজানুর হাইকোর্টের একটি আদেশ উল্লেখ করে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার নেই বলে জানালে প্রতিমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী ও আইনপ্রণেতা। আমাকে আপনি হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন। আইনের বই দেখাচ্ছেন। তাহলে পুলিশের দরকার কী?’ প্রতিমন্ত্রী নিজেই গণশুনানির এই ভিডিও তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন। 

ওই রাতেই ওসি মিজানকে সিংড়া থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু একদিন পরই প্রত্যাহার আদেশ বাতিল করে তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, সিংড়া উপজেলা চত্বরে আয়োজিত গণশুনানিতে জনসমক্ষে ওসির ওপর প্রতিমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশ করার বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি পুলিশ। যে কারণে ওসি মিজানকে প্রত্যাহারের পরে তাকে দায়িত্বে পুনর্বহালের দাবি জানায় বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। (ডেইলি স্টার বাংলা, ১৪ আগস্ট ২০২৩)।

এই ঘটনায় দুটি প্রশ্ন সামনে আসছে। ১. গণশুনানির ভিত্তিতে কোনো জনকর্মচারীকে প্রত্যাহার করা যায় কি না এবং ২. কার ক্ষমতা বেশি, এমপির না ওসির?

বস্তুত গণশুনানি রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো প্রচলিত পদ্ধতি নয়। প্রশাসন পরিচালনার সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিবিধান আছে। ফলে গণশুনানির ভিত্তিতে একজন ওসিকে প্রত্যাহারের মধ্যে যেমন সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তেমনি পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের দাবির মুখে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের মধ্যেও একজন প্রতিমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করার বার্তাটিও স্পষ্ট। 

তবে এর বিপরীত ঘটনাও আছে। যেমন প্রতিমন্ত্রী পলকের সঙ্গে একজন ওসির এই ঘটনা যেদিন ঘটল, তার দুদিন পরই অর্থাৎ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর জন্য ভোট চান একজন ওসি। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শোক দিবস উপলক্ষে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা প্রশাসন একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক হোসেন অর্থমন্ত্রী ও নাঙ্গলকোটের সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত করতে স্থানীয় মানুষের প্রতি মিনতি জানান। 

ওসি ফারুক তার বক্তব্যে বলেন, ‘নাঙ্গলকোট উপজেলার মানুষ গণহারে গণমানুষের মতো করে উনাকে আবার নির্বাচিত করবেন। এটা স্থানীয় হিসেবে আমার মনের দিক থেকে আপনাদের প্রতি মিনতি। (যুগান্তর, ১৫ আগস্ট ২০২৩)। 

অবশ্য ওসিদের ভোট চাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও একই ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় এক অনুষ্ঠানে নৌকা প্রতীকে ভোট চান একটি থানার ওসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বলছেন, ‘আমি প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপনাদের একটি কথা বলতে চাই, আপনারা আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে ভোট দেবেন, নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন।’ যদিও ওই ওসি তখন দাবি করেছিলেন যে, তার বক্তব্য এডিট করে বিকৃত করে ছাড়া হয়েছে। (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮)।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা জনকর্মচারী। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তার বেতন হয়। তিনি কোনো দলের কর্মচারী নন। অতএব তিনি কী করে কোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান? 

রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতীক বা প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান, সেটি কি পুরো বাহিনীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করে না? 

নিশ্চয়ই একজন দুজন ওসির বক্তব্য পুরো বাহিনীর বক্তব্য নয়। কিন্তু কোনো একজন বা দুজন ওসি যে এভাবে ভোট চাইতে পারছেন কিংবা চাইছেন, সেই বাস্তবতা তৈরি হলো কেন? এটি কি তাদের ব্যক্তিগত উৎসাহের বহিঃপ্রকাশ, পদোন্নতির প্রত্যাশাজনিত আনুগত্য নাকি উপর মহলের নির্দেশ? 

ঘটনা যা-ই হোক, এ ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে নির্বাচনী সংস্কৃতি। যখন একজন ওসি কোনো একজন নির্দিষ্ট প্রার্থী বা নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান, তখন সাধারণ মানুষের মনে এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে, এই বাহিনীর লোকেরা নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে না বা করতে পারবে না। এরকম একটি দুটি ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে হয়তো সান্ত্বনা খোঁজা যেতে পারে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার ও দল যেভাবে একাকার হয়ে গেছে, সেটি সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের নিরপেক্ষ চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

এই অভিযোগ বেশ পুরনো যে, পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে করে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার ফলে ওসিরা এখন অনেক এমপিকেও পাত্তা দেন না। শোনা যায়, অনেক ওসি এমনও কথা বলেন যে, তারা সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছেন। এসব বক্তব্যের সুনির্দিষ্ট রেকর্ড বা তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও জনপরিসরে অনেক দিন ধরেই এ ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। 

তবে এটা ঠিক যে, পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করাটা একপাক্ষিক বিষয় নয়। অর্থাৎ এখানে গিভ অ্যান্ড বা টেক বা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ও রয়েছে। পুলিশ যেমন রাজনীতিবিদদের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি ও মন্ত্রীদের সার্ভিস দেন, তার বিনিময়ে তারাও নানাবিধ সুবিধা নেন। 

প্রশাসনের যে কর্মকর্তা কোনো একজন প্রার্থী কিংবা কোনো একটি প্রতীকের পক্ষে ভোট চান, তিনি তো এর বিনিময় চাইবেনই। আবার এমনও হতে পারে যে, তিনি ওই দল বা ব্যক্তির কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা নিয়েছেন বলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। কিন্তু এই গিভ অ্যান্ড টেক বা দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার নিরপেক্ষ ও গণমুখী চরিত্র হারায়। যা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। 

পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই বাহিনীর আচরণ, বিশেষ করে নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের ভূমিকা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের কর্মসূচিতে তাদের আচরণ ভিন্ন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির দিনে যানবাহনে ব্যাপকভাবে তল্লাশি চালানো, এমনকি নাগরিকের মোবাইল ফোনের এসএমএস ও গ্যালারি চেক করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। 

সবশেষ গত জুলাই মাসেও রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশের দিনে এরকম একাধিক ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। ফলে নিরাপত্তার নামে নাগরিকের মোবাইল ফোন সার্চের আইনি অধিকার পুলিশের আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে এটা ঠিক যে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও পুলিশ যে কোনো নাগরিকের দেহ, এমনকি তার মোবাইল ফোন সার্চ করতে পারে। কিন্তু বারবারই বিরোধী দলের কর্মসূচির দিনে পুলিশ যেভাবে গণহারে নাগরিকদের মোবাইল ফোন সার্চ করে, সেটি পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া এটি যতটা না আইনি বিষয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নীতি-নৈতিকতা এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্মান ও অধিকারের প্রশ্ন। 

রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যে কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ প্রতিহত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। বিশেষ করে পুলিশের। সুতরাং সেই নিরাপত্তার স্বার্থে তারা অনেক কিছুই করতে পারে এটা যেমন ঠিক, তেমনি সেই নিরাপত্তার অজুহাতে তারা নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে কি না; নাগরিককে অসম্মানিত করছে কি না এবং নিজেদেরকে দেশ ও জনগণের কর্মচারীর বদলে দলীয় কর্মীতে পরিণত করছে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন। ফলে যখন তারা কোনো প্রার্থী বা নির্দিষ্ট কোনো প্রতীকে ভোট চান, তখন সেই প্রশ্ন আরও বড় আকারে সামনে আসে। তারা যদি নিজেদেরকে নিরপেক্ষ প্রমাণে ব্যর্থ হন, তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন, জনমনে সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //