মণিপুর হিংস্রতা: দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বের অশনি সংকেত

গত কয়েক মাস ধরে চলমান ভারতের মণিপুর হিংস্রতা কাণ্ডে এ পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে মর্মে দাবি করা হয়েছে। রাজ্য সরকার তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো আশাপ্রদ উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। এহেন পরিস্থিতিতে ৭ আগস্ট ২০২৩, সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে শুনানি হয়েছে। মামলার বিষয়ে তদন্ত ও মানবিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হাইকোর্টের তিন প্রাক্তন বিচারপতিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছেন, এই কমিটি সিবিআই এবং পুলিশি তদন্ত ছাড়া অন্যান্য মামলা দেখবে। 

গত মে মাসের তিন থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত পুরো মণিপুর রাজ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, মেইতেই আর কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে টার্গেট করেছিল। মণিপুরের মেইতেই সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরেই তফসিলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। আর এই দাবিটাই কুকি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের চলমান বিবাদের মূল উৎস বলে অনেকে মনে করেন। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ঘণ্টা দুয়েক দূরের পথ কুকি-অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুর জেলা। সেখানে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যখন সংঘর্ষ চলছিল তখন সেখানেই ছিলেন বছর ২৩-এর অ্যালেক্স জামকোথাং। এ সময় ওপরের একটি ভবন থেকে একটি গুলি এসে তার বুক চিরে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু তার মৃত্যু ঠেকানো যায়নি।

তখন থেকে অ্যালেক্স জামকোথাং-এর মা ঘুমোতে পারছেন না, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছেন। অ্যালেক্সের বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং ভাই এখনো ভারত-তিব্বত সীমা পুলিশে কর্মরত।

মণিপুরের ইতিহাসে এই প্রথম ধর্মীয় স্থানগুলো জাতিগত সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সভাপতি শারদা দেবীও মেনে নিচ্ছেন যে, মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতায় চার্চ পুড়েছে, মন্দির ভাঙা হয়েছে। তিনি বলেন, “চার্চ আর মন্দির দুই-ই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কুকি সম্প্রদায়ের প্রার্থনা করার স্থল গির্জাঘর এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বাড়িতে যে উপাসনা-স্থল বানায়, উভয়েরই ক্ষতি করা হয়েছে। এটা আমাদের সকলের জন্যই দুঃখের বিষয়।”

মণিপুর এখন আসলে দুই টুকরো হয়ে গেছে, যার একটা অংশে আছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ, অন্য অংশে রয়েছেন কুকিরা। এই সহিংসতা এক, দুই বা চারদিনের নয়, টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে। পরিবার ধ্বংস হয়েছে, বাড়িঘর জ্বলে পুড়ে গেছে, উজাড় হয়ে গেছে গ্রাম-গঞ্জ। যে ধরনের ফাটল দেখা যাচ্ছে মণিপুরী সমাজে, তা দীর্ঘমেয়াদের জন্যই থেকে যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী কুকি সম্প্রদায় তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পেয়েছে, অন্যদিকে মেইতেইরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের একটা অংশ যেমন সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা পাননি, তেমনই আরেকটি অংশ আবার তফসিলি জাতিভুক্ত হয়েছেন কেউ আবার অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিতে নাম তুলেছেন। মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ কুকিদের এলাকায় জমি কিনতে পারেন না, তাই তারা উপজাতির মর্যাদা চাইছেন।

সাদা চোখে সমস্যাটা জমির অধিকারের কিংবা তফসিলভুক্তিজনিত সুবিধালাভের বিষয় মর্মে অনুমিত হয়। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এটি দীর্ঘ প্রবন্ধের ভূমিকা মাত্র। মূল সমস্যা বিরাট অঙ্কের আফিম চাষ ও তার পাচারের বখরা নিয়ে। আর এই কাজে যুক্ত আছে দুঁদে রাজনীতিবিদ, জঙ্গি, ব্যবসায়ী, আন্তর্জাতিক চোরা কারবারি, মাফিয়া ও বিভিন্ন পর্যায়ের লাভ ভোগকারীরা। 

২০ জুলাই ২০২৩ কুকি সম্প্রদায়ের দুই মহিলাকে জোরপূর্বক নগ্ন করে প্যারেডভুক্ত করা এবং একদল পুরুষের দ্বারা যৌন নিপীড়নের মতো নির্লজ্জ কাজের শিকার হওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ঘটনাটি ভারতকে লজ্জা দিয়েছে এবং কোনো দোষীকে রেহাই দেওয়া হবে না। বিষয়টি শুধু বিশ্বব্যাপী নয় সারা ভারতজুড়েও মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনের কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে। 

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক ড্রাগ ব্যবসা থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া-লাওসের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল থেকে সরে ক্রমে মিয়ানমার কেন্দ্রিক চক্র গড়ে তুলছে। কেউ কেউ মণিপুরকে ভারতের হিরোইন রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। কারণ এখানে গত ৬ বছর যাবৎ প্রায় ১৫ হাজার একর জমিতে আফিম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার একর জমি রয়েছে কুকি এলাকায়। কিন্তু মাদক তৈরি হয় মূলত মেইতেইদের এলাকায়। গত ৬ বছরে ৭৮৮৩ কোটি টাকার মাদক জব্দ করা হয়েছে । আর এসব মামলার আসামি মূলত মেইতেইরা। আবার মাদক পাচারে রয়েছে কুকিদের নিয়ন্ত্রণ। তার মানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখানে বড় একটি ফ্যাক্টর।

এটি যথারীতি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও বাংলাদেশের জন্য পরিপূর্ণ উদ্বেগের। মিয়ানমার কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসাতে ইতিপূর্বে তাদের সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। অনেকে মনে করেন জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের ব্যানারে রোহিঙ্গা বিতাড়নও অনুরূপ কৌশল বাস্তবায়নে মিয়ানমার শাসক গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় করা হয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারাও যে এ ধরনের মাদক ব্যবসায় জড়িত তা তাদের কার্যকলাপে প্রতিভাত হয়েছে। এছাড়া টেকনাফ কেন্দ্রিক রুট জুড়ে মাদক ব্যবসার প্রসার দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত। 

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলার বিচারেও এটি উঠে আসে যে টেকনাফ অঞ্চল প্রকৃতই মাদক চোরাচালানের প্রতিষ্ঠিত রুটে পরিণত হয়। মাদক দমনে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণে ক্রস ফায়ারের ঘটনাগুলো উপেক্ষা করা হয়। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠে আসে। ওসি প্রদীপসহ অন্যান্য কর্মকর্তা এই মাদক রুটের কুশীলব ছিলেন এমন তথ্য উঠে আসে।

এ অবস্থায় মাদক নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সতর্কতা আরোপ এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ব্যাপারটি ত্বরান্বিত করণেও কোনো বিকল্প নেই। কারণ এই রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই মাদক চোরাচালানের সক্রিয় কর্মী মর্মে প্রমাণ রয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //