সর্বজনীন পেনশন স্কিম

অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অভিযাত্রার নতুন মাইলফলক

এ কথা তো মানতেই হবে যে, আরেকটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। গত ১৩—১৪ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কল্যাণমুখী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন এবং সেগুলোর বাস্তবায়নে বহুলাংশে সফল হওয়ার কারণে দেশকে যে শক্ত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো গেছে, তার ফলেই এই ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল পলিসি ওয়াচার এই সাফল্যের কারণে বাংলাদেশকে ‘কেইস স্টাডি অব ইকোনমিক আপলিফট’ হিসেবে অভিহিত করায় আমাদের এই সক্ষমতা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাওয়া এই সাফল্যের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। সত্যিই তিনি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে দেশকে প্রকৃত অর্থেই কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের দিকে সুচারুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে আমাদের প্রবৃদ্ধি শুরু থেকেই অন্তর্ভুক্তিমূলক থেকেছে। অর্থনীতির গতিময়তা যেন প্রান্তে থাকা মানুষের কাছেও পৌঁছে সে প্রশ্নে তিনি শুরু থেকেই আপসহীন ছিলেন।

গত ১৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারাবদ্ধ অর্থনৈতিক মুক্তির আরেকটি মাইলফলক জাতিকে উপহার দিলেন। আমাদের দেশের বয়স্ক নাগরিকরা বড়ই দুঃখী মানুষ। সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের মানুষ করেন যারা, সেই তারাই জীবনের শেষ বেলায় কী অসহ্য যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনার মধ্যে বাস করেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এই প্রবীণদের সন্তানদের অনেকেই তাদের ‘নিউক্লিয়াস’ পরিবারে বাবা—মাকে জায়গা করে দিতে খুবই কুণ্ঠিত। যারা প্রবাসী তাদের অবস্থানও একই রকম শোচনীয়। যতক্ষণ গায়ে শক্তি থাকে ততক্ষণ তারা দিনরাত পরিশ্রম করে বিদেশি মুদ্রা আয় করেন। প্রবাসে কী যে কষ্ট করে তারা দিন কাটান তা স্বচোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল। অথচ অনেকেই প্রবীণ অবস্থায় দেশে ফিরে দেখেন যে, মানমর্যাদা নিয়ে বাঁচার মতো তাদের তেমন কোনো সম্পদই নেই। পরিবারের সদস্যরা তাদের পাঠানো টাকা অনুৎপাদনশীল ভোগে ভাসিয়ে দেন বলেই এই দুরবস্থা। তবে সব প্রবাসীর পরিবারই এমন তা বলা ঠিক হবে না। কেউ কেউ আবার আধুনিক চাষবাস, মাছের খামার, গরুর খামার, ফলের চাষসহ উৎপাদনশীল কাজেও প্রবাসী আয় বিনিয়োগ করেছেন।

এমনি এক প্রেক্ষাপটে চালু হলো সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। আমার মতে এটিই হবে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির পথরেখায় সবচেয়ে উজ্জ্বল মাইলফলক। সবশ্রেণির মানুষের কল্যাণে এমন সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই কর্মসূচি উদ্বোধনকালে ঠিকই বলেছেন যে, “পরপার থেকে বঙ্গবন্ধু এই কার্যক্রম চালু হলো দেখে খুশি হবেন। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় তার প্রিয় দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমরা সর্বজনীন পেনশন চালু করছি। এতে তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা থাকবে। কারও কাছে হাত পাততে হবে না।”

নিঃসন্দেহে প্রবীণদের একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনার লক্ষ্যেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক এই কর্মসূচিটি চালু করা হয়েছে। মূলত নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা ও সমতা দেওয়ার অভিপ্রায়েই এই পেনশন—ব্যবস্থা চালু করল সরকার। আপাতত সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ চাঁদা দিয়ে এই কর্মসূচির আওতায় আসতে পারবে। সর্বজনীন পেনশনের চার ধরনের কর্মসূচি চালু হয়েছে। শিক্ষার্থী ও নারীদের লক্ষ্য করে আরও দুটো কর্মসূচি চালু হওয়ার কথা আছে। আগামীতে এক পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা—কর্মচারীরাও এই কর্মসূচিতে একীভূত হবেন বলে আশা করা যায়। এই কর্মসূচিতে ১৮ বছর বয়সে যুক্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা মিলবে। যুক্ত হতে দেরি হলে, আনুপাতিক হারে সুবিধাও কমবে। যে কেউ তার মোট চাঁদার দেয় কিস্তির চেয়ে সর্বনিম্ন ২.৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১২.৩১ গুণ টাকা পেনশন পাবেন। এই কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন পনেরো বছর। গ্রাহককে নিয়মিত চাঁদা দিতে হবে অন্তত দশ বছর। আগে মারা গেলে নমিনি পাবেন এককালীন সুবিধা। জমা টাকার ৫০ শতাংশ ঋণও পেতে পারেন একজন অংশগ্রহণকারী। মাসিক পেনশন শুরু হবে বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর। এই কর্মসূচিতে নিবন্ধন করা যাবে ঘরে বসে। অনলাইনে। চাঁদা দেওয়া যাবে ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবার (বিকাশ, নগদ ইত্যাদির) মাধ্যমে। আপাতত সোনালী ব্যাংকের সব শাখা ব্যাংকিং সুবিধা দেবে। পরে হয়তো অন্যান্য ব্যাংকও যুক্ত হবে। বলা বাহুল্য সময়োচিত এই উদ্যোগে ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে শুরু করেছেন দেশের নাগরিকেরা। 

আমাদের অর্থনীতি সামনের দিকেই হাঁটছে। ২০২৬ সালের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উন্নয়নশীল দেশ হবে। আমাদের মানবিক উন্নয়নসূচকগুলোও বেশ ইমপ্রেসিভ। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, পুরনো পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো এখনই বেশ ভঙ্গুর। ভবিষ্যতে তা আরও নড়বড়ে হয়ে যাবে। সেই সময়কে মাথায় রেখেই আমাদের অর্থনীতির রূপরেখা সাজাতে হবে। সেই বিচারে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি খুবই অগ্রসর চিন্তার ফসল। তাই তো এদেশের প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই এই কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সবাই বলেছেন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য এটি খুবই প্রাসঙ্গিক একটি উদ্যোগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্ধ—শতাধিক বছর বাদে এলো এই আধুনিক কর্মসূচি। ডিজিটাল বাংলাদেশে এমন একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের সকল ধরনের প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এখন আমাদের হাতের পাশেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর মানবিক উন্নয়ন দর্শনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তিনিই আবার ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশের প্রবক্তা। তাই সকল পেশার, শ্রেণির মানুষকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসার তার এই সাহসী উদ্যোগটি নিশ্চয় পদ্মা সেতুর পাশাপাশি সমহারেই বার বার উচ্চারিত হবে।

পেনশনের এ টাকা কোথায় বিনিয়োগ হবে তা এখনই নির্ধারণ প্রয়োজন। আমি মনে করি, পেনশনের টাকার সিংহভাগ ট্রেজারি বন্ড ও প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্র আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি দ্বারা রেট করা প্রথম চার পাঁচটি ব্যাংকের এবং ভালো মানের সরকারি ব্যাংকের মেয়াদি আমানতেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে এই বিনিয়োগ যেন হয় সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত। আর সে কারণেই দরকার সুদৃঢ় একটি জাতীয় পেনশন রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানের। অবশ্য সংশ্লিষ্ট আইনেও এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমোদন দেওয়া আছে। আপাতত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এই প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমার মনে হয় এ অন্তর্বর্তীকালীন এটিই সঠিক ব্যবস্থা। কোনো অবস্থাতেই যেন এই কর্মসূচি কোনো কাজেই সামান্য আস্থাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। যেহেতু এরই মধ্যে এ কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতিকরণের অপচেষ্টা চলছে, তাই এর সকল কর্মকাণ্ডই হতে হবে আরও দক্ষ এবং স্বচ্ছ। সেজন্য এখন থেকেই খুবই পেশাদারি ‘কমিউনিকেশন’ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে খুব সহজেই অনলাইনে হিসাব খুলতে পারেন, মোবাইল আর্থিক সেবায় অর্থ জমা করতে পারেন, উপযুক্ত অ্যাপ—ভিত্তিক চাঁদা জমা করতে পারেন, সোনালী ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় গিয়ে নির্দিষ্ট করা টেবিলে সহজেই হিসাব খুলে চাঁদা জমা দিতে পারেন এবং ঐ হিসাব থেকেই প্রতিমাসে ব্যাংকই স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা কেটে গ্রাহকদের পেনশন হিসাবে টাকা জমা দিতে পারেন—সেসব কথা খুবই স্মার্ট বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় যেন নিয়মিত জনগণকে বলতে থাকে সেই প্রত্যাশাই করছি।

‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন যে একটি জাতি উন্নতির পথে যতই এগিয়ে যাবে সেখানে মানুষেরা তত বেশি ‘মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব’—এর দাবিদার হয়ে উঠবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে আমরা আমাদের নাগরিকদের জন্য তেমনই একটি মানবিক জীবন নিশ্চিত করতে পারব। ফলে এই স্কিমটি হয়ে উঠতে পরে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রার নতুন মাইলফলক।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //