ব্রিকসে বাংলাদেশের ঝোলায় কেবল ‘আশ্বাস’

দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলনে জোটের পাঁচটি দেশের সঙ্গে নতুন যুক্ত করা হয়েছে ছয়টি দেশকে। এক নজরে ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়নশীল দেশের জোট ব্রিকস। যার লক্ষ্য ‘গ্লোবাল সাউথ’ হিসেবে এই জোটের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করা।

নতুন ছয়টি দেশ যোগ দেওয়ার আগেই বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা ব্রিকস সদস্যদেশগুলোতে থাকেন। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনেরও এক-চতুর্থাংশ এই দেশগুলো থেকে আসে। এই পাঁচ দেশ পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর।

এমনকি বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (আট ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে এই পাঁচটি দেশ থেকে। ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বেশ আগে থেকেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, ব্রিকস মুদ্রা প্রবর্তন এবং নিজস্ব রিজার্ভের কথা বলে আসছে।

এটি কার্যকর হলে ব্রিকস দেশগুলো তাদের নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। এতে ডলারে নির্ভরতা কমবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এবার নতুন যোগ হওয়া পূর্ণ সদস্য দেশগুলো- আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। যাদের অন্তর্ভুক্তি ২০১৪-এর জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। এছাড়া আরও ৪০টি দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে আবেদন করেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

জোহানেসবার্গে সম্মেলন শুরুর আগে ব্রিকসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত হওয়ার পর দেশের পত্র-পত্রিকা আগাম সংবাদ প্রচার করে দেয়, ‘বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হতে যাচ্ছে।’ বাস্তবে এবারকার বৈঠকে বাংলাদেশের যোগদানের প্রসঙ্গ আলোচনাতেও আসেনি। কেন আসেনি? এই প্রশ্নের উত্তর সাধারণভাবেই অনুমান করা যায়। ব্রিকসে সেই সব দেশই সদস্য যারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। বাংলাদেশ স্বাবলম্বী নয় বলেই বিবেচিত হয়নি। এর মধ্যে কোনো পছন্দ-অপছন্দ বা ঘোরপ্যাঁচ নেই। প্রসঙ্গ উঠতে পারে, ‘ভারত বাংলাদেশের যোগদানের বিরোধিতা করায় বাংলাদেশের নাম বিবেচিত হয়নি।’ ২৪ আগস্ট ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে ছয়টি দেশকে এই জোটে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, এসব দেশ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিশর এবং ইথিওপিয়া।

বাংলাদেশও এই জোটে যোগ দিতে পারে বলে এর আগে আভাস পাওয়া গেলেও নতুন ছয়টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। সর্বশেষ নতুন সদস্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ।

ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকা যান। এ বছর জুনের মাঝামাঝি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, আগস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করতে পারে।

ভারত কেন বিরোধিতা করল, তার কারণ বুঝতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকজনকে আরও ‘স্মার্ট’ হতে হবে। দেশ উন্নতির ‘রেকর্ড’ করে ফেলেছে বলে বেশুমার প্রচার হয়। বিদেশিরাও সমানতালে কণ্ঠ মিলিয়ে উন্নয়নের সাফাই গায়। সে সময় বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাটদের একবারও মনে হয় না ক্যানভাসাররা আপনার প্রশংসা করেই আপনাকে পণ্য গছাবে। এটাই বিজনেস পলিসি। তারা উন্নয়নের প্রশংসা করা মানে আপনাকে আরও স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্টে ঠেলে দিয়ে র-ম্যাটরিয়ালস বিক্রি করবে। জাপানি মন্ত্রী যখন বলে, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপানকেও ছাড়িয়ে যাবে’, তখন বুঝতে হবে তারা আপনাকে ভারত, চীন থেকে গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত করতে চায়।

এর সঙ্গে ভারতের বিরোধিতার সম্পর্ক রয়েছে। ভারত জানে, বাংলাদেশ অনেকাংশে তাদের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ কয়েকটি বাদে প্রায় সকল ধরনের পণ্য ভারত থেকে আসে। বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়ে গেলে ভারতকে ‘প্রতিবেশী হিসাবে’ কেনা দামে গম দিতে হয়। সারা বছরই কোনো না কোনো পণ্যের ঘাটতি হলে সাপ্লাই দিতে হয়। এখন যেমন পেঁয়াজ সাপ্লাই নিরুৎসাহিত করতে তারা ৪০% ট্যাক্স বসিয়েছে। তাই ভারতের সাউথ ব্লক মনে করে এমনিতেই বাংলাদেশের ‘অর্থনীতি’ ভারতের জন্য চাপ, তার ওপর ব্রিকসের সদস্য হলে চাপটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে যাবে।

৩ দিনের এই সম্মেলনের আলোচনার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সম্প্রসারণের বিষয়টি। ব্রিকসের সদস্যরা সবাই এর সম্প্রসারণের পক্ষে মত দিলেও নেতাদের মাঝে কিছু বিষয়, যেমন কত দ্রুত এবং কতগুলো দেশকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেটি নিয়ে মতভেদ ছিল। সেখানে ভারতের বিরোধিতার চেয়ে বড় বিষয় বাংলাদেশের যোগদানের পক্ষে কেউ কথা তোলেনি।

দ্বিতীয় দিন শেষে রাতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যমতে ‘ব্রিকসে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ইস্যুতে চীন বাংলাদেশকেই সমর্থন দেবে বলে কথা দিয়েছেন প্রসিডেন্ট শি জিনপিং।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বার্তা থেকে আশা তৈরি হয়েছিল, এবার হয়তো বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পাবে। তবে বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে জোটটিতে যোগ দিতে যেসব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমত ব্রিকসে যাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার মধ্যে সবগুলো দেশই অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে অগ্রসরমাণ দেশ এবং এদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাই বাংলাদেশের তুলনায় ভালো।

“দ্বিতীয় কারণ হতে পারে যে আমরা সাম্প্রতিককালে আগ্রহ দেখিয়েছি। কাজেই আগ্রহ দেখানো এবং তার জন্য মোবিলাইজেশন যেটা দরকার সেটা কতটুকু হয়েছিল এটা একটা ব্যাপার। 

তার মানে, বিকল্প একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার মতো সক্ষমতা রাখে এমন সব দেশকেই এবার ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইথিওপিয়া কি সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে? কিছুদিন আগেও যে দেশটিকে বলা হতো, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধায় জর্জরিত দেশ।’ উন্নত দেশগুলোর সাহায্যের ওপর নির্ভর করত সেখানকার লাখ লাখ মানুষের বাঁচা-মরা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া একটি বিখ্যাত ছবি ‘শকুন এবং মানব শিশু খাবার কাড়াকাড়ি করছে!’ সেই ইথিওপিয়া বিকল্প একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার মতো সক্ষমতা রাখতে পেরেছে, বাংলাদেশ পারেনি। এটাই নির্মম বাস্তবতা।

বাংলাদেশকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, চারটি দেশকে যুক্ত করা হলে তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি।

ব্রিকস বিষয়ক আলাপ এখানেই শেষ। এরপরও যে বিষয়গুলো অর্থহীন এবং হাস্যকর তা হলো বাংলাদেশের কিছু মিডিয়ার তৈলাক্ত বয়ান। একটি সংবাদ মাধ্যম লিখেছে, ‘ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ দুই নেতার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অত্যন্ত সফল হয়েছে। উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা হয়েছে তাদের মধ্যে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, আর বাংলাদেশের কাঁঠাল, আম, পেয়ারা চীন কিনতে চেয়েছে তারা!’ ভাবা যায়? কোথায় ব্রিকস আর কোথায় কাঁঠাল, আম, পেয়ারা? 

ওয়ান চায়না নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি এ কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে সবসময়ই থাকবে চীন। চীন মনে করে বাংলাদেশ তাদের কৌশলগত অংশীদার।’ 

ড. এ কে আব্দুল মোমেন আরও বলেন, ‘এদিকে সন্ধ্যায় একটি ভোজসভা হয় ব্রিকসে আসা সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে চেয়ার থেকে উঠে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন।’

এই যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘চেয়ার থেকে উঠে এসে’ কথাটা লেখার মানে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডিংয়ের বালখিল্যতা। প্রচলিত ভদ্রতা অনুযায়ী যে কোনো অনুষ্ঠানে নারীকে তার কাউন্টার পার্ট পুরুষ আগে বসতে আহ্বান করে। তেমনি কাছে এসে দেখা করার জন্য নারীর কাছে এসেই দেখা করে কিংবা কথা বলে। এই বিষয়টা জোর দিয়ে অজ্ঞতা কিংবা অভদ্রতা।

ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য ব্রিকসের পরের বৈঠকের আগে বাংলাদেশকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেটা বলার দায়িত্ব জনগণের নয়। সেটা মন্ত্রিপরিষদ ও ডিপ্লোম্যাটরা ঠিক করবেন। তবে বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণের নিরিখে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক গ্রুপ, ব্যাংক, সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট দিয়ে আবেগী সাধারণ মানুষকে পক্ষে টানা গেলেও আন্তর্জাতিক স্তরে তা কোনো কাজে দেয় না।

মূল কথা হলো, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে পণ্যের কেনা-বেচায় কখনো কোনো দেশ এমন ‘ব্যালান্স করে’ চলতে পারে না। ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে’ ‘অর্থনৈতিক শত্রুকে’ পরাজিত করেই বাজারে টিকে থাকতে হয়। শেষ বিচারে কোনো না কোনো পক্ষে যেতেই হয়।

-লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //