আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কী হবে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, যারা নিয়মিত বিরতিতে এমন সব কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়, যা নিয়ে মানুষ হাসিতামাশা করে।

অথচ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরিবারকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে একটি সত্যিকারের ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারত। কিন্তু সেটি পারেনি বা পারছে না। ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির বাইরে ইসলামিক শক্তি, বিশেষ করে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তৃণমূলে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছে।

প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টি কেন আপন শক্তিতে জ্বলে উঠতে পারে না, নাকি তারা জ্বলে উঠতে চায় না? তারা সরকারের সঙ্গে আছে এবং নেই-এর মাঝখানে থেকে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ থিওরি প্রয়োগ করে কি সব সময় নিজেদের সুবিধাটুকু আদায় করে নিতে চায়? তারা কি নিজেদেরকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবেও প্রমাণ করতে পেরেছে? কেন পারেনি? তারা কি আদৌ বিরোধী দল হতে চেয়েছে?

জাতীয় পার্টি বারবার সংবাদ শিরোনাম হয় মূলত দলের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে রওশন এরশাদ এবং তার দেবর জি এম কাদেরের মধ্যে টানাপড়েনের কারণে। যদিও বারবার তাদের তরফে দাবি করা হয় যে, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এমনকি জিএম কাদের এমনও বলেছেন, রওশন এরশাদের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য যা-ই হোক না কেন, তিনি সব সময়ই বড় ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে রওশনকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন।

সবশেষ গত আগস্টে জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এই সফরে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাদের খোলামেলা আলোচনা হলেও কার কার সঙ্গে, কী কী বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারবেন না বলে তিনি জানান। এসময় তিনি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করার খবর সম্পর্কে বলেন, ‘এটা উনি করেননি। ওনাকে দিয়ে এসব করানো হচ্ছে। তিনি আমার ভাবি। আমার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের সহধর্মিণী। আমার বড় ভাইকে আমরা সবসময় নিজের বাবার মতো মনে করেছি। সে হিসেবে ভাবিকেও আমরা ছোটবেলা থেকেই মায়ের মতো করে দেখে আসছি। তাকে সেভাবেই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে আসছি।’ (নিউজ বাংলা, ২৩ আগস্ট ২০২৩)।

তবে মুখে যতই বলা হোক যে কাদের ও রওশনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, কার্যত জাতীয় পার্টির মূল অংশ এখন দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি জি এম কাদের গ্রুপ, আরেকটি রওশনপন্থি। বলা হয়, যারা জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে পারেননি এবং সরকারের সঙ্গে থাকতে চান, তারাই রওশনের দলে আছেন। আর কিছুটা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষ রাখতে সচেষ্ট অংশটি জি এম কাদেরের সঙ্গে। তবে জি এম কাদের সরকারের সমালোচনায় যতই সরব হোন না কেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন। তাছাড়া জি এম কাদের মাঝেমধ্যে সরকারের সমালোচনা করলেও বিএনপি তাকে কতটা বিশ্বাস করে বা তাকে নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা জোট গঠন করবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কারণ রাজনীতিসচেতন মানুষ জানেন, শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলা বা পল্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির জুড়ি নেই।

এরশাদের মৃত্যু হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। তখন দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন জি এম কাদের। সেই থেকেই দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার সঙ্গে রওশন এরশাদের বিরোধ চলছে। দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ, আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এবং দলের অবস্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব থাকায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্তি অনেক কমে গেছে।

জাতীয় পার্টির সবশেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় গত ২২ আগস্ট। ওই দিন দুপুরের আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছড়িয়ে পড়া একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রওশন এরশাদ নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রওশন এরশাদের স্বাক্ষর থাকলেও পরে তিনি দাবি করেছেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তাছাড়া যাদের নাম ব্যবহার করে এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে, তারা সবাই গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিষয়টি ভুয়া। দিনভর জাতীয় পার্টির এই নাটক নিয়ে তোলপাড় হয়। পার্টির বনানী কার্যালয়ে নেতাকর্মীরা এর প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশও করেন। সন্ধ্যা নাগাদ বিষয়টি পরিষ্কার হয়। রওশন নিজেই নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা বিষয়ক এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও দাবি করেন, ‘এটা ফেক নিউজ।’ প্রশ্ন হলো, কারা এটি ছড়ালেন? দলের মধ্য থেকেই তো এটি ছড়ানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? নাকি জাতীয় পার্টি সব সময়ই এরকম ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় থাকতে চায়? 

প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কী করবে? তারা কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে নাকি বিরোধী দল হওয়ার জন্য আলাদাভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে? এটি নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর। যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে তাহলে তারা হয়তো জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই নির্বাচন করবে। আর বিএনপি না এলে হয়তো আগের মতোই ‘গৃহপালিত’ বা ‘সরকারি বিরোধী দল’ হওয়ার জন্য আলাদাভাবে নির্বাচন করবে। তবে জাতীয় পার্টি বরাবরই একটি ‘আনপ্রেডিকটেবল’। ফলে তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত মন্তব্য করা কঠিন।

জি এম কাদের হয়তো চাচ্ছেন, বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় পার্টি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। কিন্তু বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। অন্যদিকে রওশন ও তার অনুসারীরা সরকার বিরোধী অবস্থান নিতে চান না। তারা বরং অতীতের মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটেই থাকতে চান। তারা সরকার বিরোধী জোটে গিয়ে ঝুঁকি নিতে চান না। তবে জাতীয় পার্টির যে অতীত কর্মকাণ্ড, তাতে জি এম কাদের যদি শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারেন যে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসছে, তখন তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবেন কি না বা জোট করলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসবেন কি না, তাও হলফ করে বলা মুশকিল।

১৯৮৬ সালে গঠিত এই দলটি এখন ৪ ভাগে বিভক্ত। এরশাদের নেতৃত্বে ছিল মূল দল (প্রতীক লাঙল)। তার মৃত্যুর পরে মূল দলের নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয় দেবর-ভাবির লড়াই। আবার এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশাকেও মাঝেমধ্যে সক্রিয় মনে হয়। এর বাইরে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-জেপি (প্রতীক বাইসাইকেল), নাজিউর রহমান মঞ্জুরের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (প্রতীক গরুর গাড়ি) এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (প্রতীক কাঁঠাল)। 

সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। ফলে চার ভাগে বিভক্ত জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনের আগে আরও একটি ভাগে ভাগ হয়ে গেলেও সেটি আশ্চর্যের কিছু হবে না। 

তবে রওশন ও কাদের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ ও বিভক্তি যতই থাকুক, দিন শেষে জাতীয় পার্টি যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরের কোনো দল নয় বা আওয়ামী লীগ যা চায়, তার বাইরে তারা যেতে পারবে না, সেটিই হচ্ছে নির্মম সত্য। তাছাড়া রাজনীতিতে এরকম কথাও প্রচলিত আছে যে, জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করে রাখতে দলের শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রাখার পেছনে সরকার তথা সরকারি দলেরও হাত রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //