‘ওরে নীল দরিয়া’র আব্দুল জব্বারকে মনে পড়ে?

“গায়ক-শিল্পী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত যোদ্ধা আব্দুল জব্বারকে নিয়ে একটু লিখবেন? আপনি তো পুরনো দিন নিয়ে লেখেন। পড়ি, ভালো লাগে। ধন্যবাদ।”-বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম টেলিফোনটা পেয়ে। পত্রিকা খুঁজে দেখলাম কম বেশি অনেকেই লিখেছেন তাকে নিয়ে, তবে এমন বড় কিছু নয়- এটাই মিডিয়ার আর স্মৃতির নিয়ম। একসময় সবাই ভুলে যায়। তবে ইউটিউব, ফেসবুকের কল্যাণে আমরা তার গান খুঁজে পাই। কেমন আছেন আব্দুল জব্বার?

দুই

আমি রেডিও কালের লোক। আমাদের জীবনে রেডিও ছিল সবার। মানে সবাই তিনটা স্টেশন শুনত। ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’- গান, খবর, কথিকা এইসবের জন্য। ‘আকাশবাণী কলকাতা’ গানের জন্য। আর ‘রেডিও সিলন’ গানের জন্য, হিন্দি গান। আমাদের জীবনে গান বড় ভূমিকায় ছিল অন্য সবার মতো। আর ছিল ক্রিকেট কমেন্ট্রি। সবাই তখন ছোটবেলা থেকে শুনত ইংরেজি/বাংলা দুই ভাষাতেই। দেখার সুযোগ কই? ইন্ডিয়ার এক কমেন্টেটর ছিল নাম ‘ভিজি’, খুব বাজেভাবে করত তাই সবাই মজা পেত, শুনত। 

পরের দিকে একটা অনুষ্ঠান হতো ঢাকা বেতার কেন্দ্রে, যেটা ছিল সরকারি প্রোপাগান্ডা। নাম ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আসর’-বোধহয় ১৯৬২ সালের পর থেকে। ওতে একটা নাটক হতো, নাম মনে নাই তবে চরিত্রগুলো ছিল খুব জনপ্রিয়; বিশেষ করে ‘মজিদের মা’ নামের চরিত্রটি। এখন সব হারিয়ে গেছে মাথা থেকে। ওই রকম রেডিওর যুগেই ৬০-এর দিকে একদিন রাতে গান শুনলাম এক নয়াশিল্পীর। গানটা মনে আছে, “মন রে, এই ভবের নাট্যশালায়, মানুষ চেনা দায় রে মানুষ চেনা দায়।” আব্দুল জব্বার হাজির।

তিন

আমি এক ১০/১১ বছরের বালক, কিন্তু তখনই মনে হয়েছিল কী দারুণ গাওয়া। বাবা-মা, এক মামা যে ঘরে ছিল সবাই তারিফ করেছিল গানের। ‘মনো রে’ করে যে টানটা দিয়েছিল আজও কানে বাজে। আমি সেই দিন থেকেই ভক্ত হয়ে গেলাম। নিজে গান শিখতাম, তাই আরও ভালো লাগত। খুব দ্রুত জনপ্রিয় হলেন তিনি বা আগে থেকেও ছিলেন। রেডিও থেকে সিনেমা বেশি দূরে ছিল না। এবং একদিন প্রধান গায়কদের শীর্ষে চলে গেলেন।

চার

আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৮ সালে বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন। চলচ্চিত্রে প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সাল থেকে বিটিভিতে।

পাঁচ

১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘সংগম’ ছবি তার প্রথম সিনেমা। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ গানটি আজও ভীষণ জনপ্রিয়। একই বছর ‘পিচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ তার বিশাল হিট গান। এখন অবশ্য ট্র্রাফিক জামের কারণে কেউ পিচ ঢালা পথ দিয়ে হাঁটতে পারে না, ওটা কেবল গাড়িবাজদের দখলে। এক শহর কত পাল্টে যায়। 

হয়তো তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ছবিতে আলম খানের সুরে গাওয়া ‘ও রে নীল দরিয়া’ গানটি। গানটার গুণ হচ্ছে সেই রেডিওর যুগ অতিক্রম করে তিনি চলে এলেন ইন্টারনেটের কালে, গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন। ৬৫ বছরের বেশি আগে থেকে তিনি গান গেয়েছেন, আজও বহু মানুষ শোনে তার গান। যেমন আমি। ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার আয়োজনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা ২০ গানের মধ্যে স্থান করে নেয়। অর্জন, প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি, সব তার কাঁধের ব্যাগে।

ছয়

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অনেক গান দেশের সবাই শুনেছে। যারা সেই রেডিওতে যোগদান করেন তাদের মধ্যে আব্দুল জব্বার অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছিলেন। কারণ তার না গেলেও চলত। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না, কিন্তু যাওয়া দরকার মনে করেছিলেন তাই যান। তার উপস্থিতি ওই বেতার কেন্দ্রকে এক আলাদা মর্যাদা দেয়। গবেষণা করতে গিয়ে আমরা যাদেরই জিজ্ঞাসা করেছি, তাদের কাছেই শুনেছি তার নাম। বড় মাপের মানুষ থেকে ইতিহাসের মানুষ হয়ে যান।

সাত

আব্দুল জব্বার আরও অনেক সম্মান পেয়েছেন, কারণ তিনি তার যোগ্য ছিলেন। ‘ওরে নীল দরিয়া’ গান নয় কিংবদন্তির নাম। কিন্তু এই পরিণত- বড্ড বেশি পরিণত বয়সে এসে মনে হয় অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে যারা শিল্পী কবি, যাদের কিছু শূন্যতা থাকে কি? কিছু কষ্ট থাকে কি, যাকে আমরা আড়াল করে অথবা পাশ কাটিয়ে চলে যাই, জানতে চাই না। জানার দরকার আছে? হয়তো নেই, কিন্তু আমরা অনেক কিছুই জানতে চাই না। কোনো বিষয় নিয়ে বরং মনের ভেতর এই বড় মাপের মানুষগুলোকে নিয়ে নিজেদের মনের নির্মাণ বানাই নিজের জন্য।

বোধহয় সেটাই ভালো। তবে এটা জানি অনেক শিল্পীর মতো তার মনে কষ্ট ছিল, যার রাস্তার বাঁক ঘুরেছিল নানা পথে। হতেও পারে, নাও পারে। তবে আমাদের গোটাটা জানা উচিত। তাহলে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব কেন ওই গানগুলো অত দরদ দিয়ে তিনি গাইতে পারতেন, কেন চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের রেডিওতে, আরও কত কিছু!

আমাদের গায়ক, আমাদের যোদ্ধা, আমাদের কিংবদন্তি, আব্দুল জব্বার, আপনাকে হাজার সালাম।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //