ছিটমহল: আট বছর পরে একদিন

ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ভূখণ্ড। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল ছিল মোট ১২টা, তার মধ্যে প্রধান দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই ছিল চন্দ্রখানা নামে বাংলাদেশের একটি ছিটমহল।

দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ছিল ১৬২টি ছিটমহল। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি বাংলাদেশে, আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিল ভারতে। ২০১৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার এবং বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর ১৪ হাজার লোকসংখ্যা ছিল। বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এর মধ্যে ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে ছিল ৪টি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে, ৪৭টি কুচবিহার ও ৪টি জলপাইগুড়ি জেলায়।

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্য দিয়ে রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় ছিটমহলের। এক দেশের ভূখ- থেকে যায় অন্য দেশের অংশ হিসেবে। উদ্ভব ঘটে এক মানবিক সমস্যার। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তিতে বলা আছে- ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন যেখানে থাকতে চাইবে সেখানেই থাকতে পারবে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ছিটমহলবাসী ও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সমস্যা সমাধান কার্যকর হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে। বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২টি ছিটমহল বিলুপ্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে স্থানীয়রা মোমবাতি প্রজ্বালন করে উল্লাস প্রকাশ করেন।

ছিটমহল বিলুপ্তির আগের অভিজ্ঞতার কথা বললে বর্তমানের বদলে যাওয়া চিত্রকে আর মনে পড়ে না। লালমনিরহাটে ছিল ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। এই ছিটমহলে ঢুকতেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) নিরাপত্তা চৌকি। এরপর তিনবিঘা করিডর। আবার বিজিবির চৌকি। মাঝখানের তিনবিঘা করিডর ভেদ করে চলে গেছে ভারতীয় সড়ক। সড়ক ও করিডরের নিয়ন্ত্রণ করে বিএসএফ। এই সড়কেই বিএসএফের গেট। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সব বাসিন্দার একটাই চিন্তা নিয়ে দিন গুজরান করতে হতো, যে করেই হোক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে যে ‘গেট ফেইল’। গেট ফেইলের বৃত্তে বন্দি ছিল এখানকার ১৫ হাজার মানুষের জীবন। বাংলাদেশ থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যেতে ভারতের তিনবিঘা করিডর পেরোতে হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তিনবিঘা করিডরের গেট খুলে দিত সকাল সাড়ে ৬টায়। গেট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। মাঝখানের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সবার বাইরের কাজ সারতে হতো।

সেই জীবনের কথা মনে করে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার ছেলে বাবুল মিয়া (৩৪) বলেন, জীবন মনে হতো জেলখানার মতো। সকাল সাড়ে ৬টার আগে গেট খুলবে না, আবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর বন্ধ, এর মধ্যে কত বিপদ-আপদ হয়েছে। সব চোখ বুজে সহ্য করতে হতো। যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। এমন মুক্ত বাতাস দেখতে পারব তা কোনোদিন ভাবিনি।

ছিটমহল বিলুপ্তির পর কুড়িগ্রামের বিশাল ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় ঢুকতেই ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নীল কমল নদের ওপর একটি ৩৬ মিটার সেতু চোখের কোণে ভেসে উঠল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৭ সালে এই সেতু নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এতদিন ছিটমহলবাসীর যাতায়াতের দুঃখ ছিল এই নীল কমল নদ। এই সেতুর মাধ্যমে সেই দুঃখ দূর হয়েছে। সেতু পার হলেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে নির্মিত দাশিয়ারছড়া সংবলিত মানচিত্র ও সাম্প্রতিক উন্নয়নের তথ্যফলক। সেখান থেকে ডান দিকে কালীরহাট সড়ক হয়ে সমন্বয়পাড়া, বোর্ডঘর, রাসমেলা, টংকার মোড়, বানিয়াটারী ও ছোট কামাত গ্রাম ঘুরতেই চোখে পড়ল অনেক ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। যেগুলো একসময় ছিল ঝুপড়ি ঘর, বিনিময় চুক্তি কার্যকর হওয়ার অল্পদিন পরই সেখানে শুরু হয় উন্নয়নের কাজ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। ছিটমহল বিনিময়ের আগে এসব ঘরের বেড়া ও ছাউনি ছিল টিনের। এখন কিছুদূর পরপর আধাপাকা ঘর। জেলা কুড়িগ্রামে অবস্থিত ১২টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় দাশিয়ারছড়া কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায়। এই ছিটমহলের আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার। ছিটমহল বিলুপ্তির ৮ বছর পর কেমন আছে ছিটমহলবাসী? 

জানতে চাইলে দাশিয়ার ছড়ার কৃষক রসুল মিয়া জানান, এই দাশিয়ার ছড়ার দুর্গতির কথা কী বলব, ভারত থেকে কিছু জিনিসপত্র এনে বেচে চলতে হতো। এ নিয়ে কত ঝামেলা হতো। পুলিশ আসত। বাড়ি বাড়ি ভারতের মালামাল খুঁজত। নাগরিকত্ব নিয়ে আমরা চিন্তিত থাকতাম। কিন্তু এখন আমাদের ঠিকানা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিটমহলবাসীর জাতীয় পরিচয়পত্র হয়েছে। এখন আমরা সব সুবিধা পাই।

এলাকার কৃষক এনামুল মিয়া খুব খুশি। তিনি বিস্তীর্ণ ক্ষেত দেখিয়ে বললেন, আট বছরে আমরা এমন কৃষক হয়ে যাব ভাবিনি। নাগরিক সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি তাদের আমূল বদলে দিয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, প্রশস্ত পাকা সড়ক, সরকারি উদ্যোগে নির্মিত সুদৃশ্য মসজিদ-মন্দির সব হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে। এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ছিটমহল বিনিময়ে দুই বছরের মধ্যেই বিশেষ বরাদ্দে প্রায় ২৪ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ হয়েছে দাশিয়ারছড়ায়। এর মধ্যে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, ২৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে দাশিয়ারছড়ায়। এ ছাড়া কালিররহাটে কমিউনিটি রিসোর্স সেন্টার, ৫টি মসজিদ, একটি মন্দির, একটি ব্রিজ এবং ১০টি হতদরিদ্র পরিবারের বসতবাড়ি নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রায় দেড় কোটি টাকার ব্রিজ ও রাস্তা পাকাকরণসহ পনেরোশ পরিবারের মাঝে টিসিবির পণ্যের কার্ড বিতরণ হয়েছে। কৃষকদের উন্নয়নের জন্য উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর দুইশ প্রদর্শনী, বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ, কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য ৫০% ভর্তুকিতে পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে ভূমি জটিলতার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিরসন হয়ে গেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর ও সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ৯ একর জমির প্রাক জরিপ শেষ করে খতিয়ান হস্তান্তর হয়েছে। ঘরে ঘরে সুপেয় পানি আর স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকার যুব ও যুব মহিলাদের দেওয়া হয়েছে নানা ট্রেড প্রশিক্ষণ। 

দাশিয়ারছড়ার করম আলী (৬০), শাজাহান মিয়া (৫৬) বলেন, সরকার বিনা খরচে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ-সংযোগ স্থাপন করেছে। যেসব সড়কে দীর্ঘ ৬৮ বছরে (১৯৪৭-২০১৫) রাষ্ট্রীয়ভাবে সামান্য মাটিও পড়েনি, সেসব সড়ক এখন পিচঢালা। শুধু পঞ্চগড়েই প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়ক ৩

পাকা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ছিটমহলগুলোয়ও প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পাকা হয়েছে। ছিটমহলগুলোর সড়ক প্রায় সবই পাকা হচ্ছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোয় এখন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি স্নাতক পর্যায়ের কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আছে মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান এবং শ্মশান; সবই সরকারের অবদান। কুড়িগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, মূলত ছিটমহল তুলে দেওয়ার আগে সেখানকার যে পরিস্থিতি ছিল সেটা মিডিয়ায় বারবার এসেছে। তুলে দেওয়ার পর কী হবে, আমরা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন সেখানে উন্নয়নের গতিপ্রবাহ দেখে বিস্মিত হতে হয়। এক কথায় এটাকে জীবন বদলের গল্প বলা যায়। সাংবাদিক এমএস সাগর জানান, ছিটমহল বিনিময়ের পর যে সুফল পেয়েছেন, তাতে তাদের জীবনের পুরনো অধ্যায়ের অবসান হয়েছে, শুরু হয়েছে আলোকিত দিনের।

সাংবাদিক লাইলি বেগম জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকে চলে আসা এই জটিল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে বর্তমান সরকার এই অঞ্চলের মানুষকে এমন এক জীবন দান করেছে যা একদম চিন্তার বাইরে ছিল। এখন সেখানে যে শান্তির প্রবাহ চলছে তা দেখলেও ভালো লাগে। দেশবাসী দেখছে এক জীবন বদলের গল্প।

- সাংবাদিক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //