ভারত ও জি-২০ : বৈশ্বিক বিভাজন হ্রাসের নয়া উদ্যোক্তা

গত রবিবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটেছে। দুই দিনের সম্মেলনে ‘ঐক্যের বার্তার’ যে আহ্বান বেশ কিছুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছিল, তা অনুমোদিত হয়েছে। এই সম্মেলনের ফলাফলের মাধ্যমে ‘সত্যিকারের কার্যকর লক্ষ্যসমূহ’ অর্জিত হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। ভারত এ ধরনের কার্যধারাকে দক্ষতা এবং যোগ্যতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশংসিতও হয়েছে। তবে জি-২০-এর সদস্য দেশগুলোর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের কারণে এই বিষয়ের ঘোষণা নিয়ে একটি সংশয়পূর্ণ জায়গা তৈরি হওয়ার অবকাশ থেকে গেল। এই রকম চিন্তার বিভ্রান্তি সত্ত্বেও ৮৩টি অনুচ্ছেদ সংবলিত দিল্লি ঘোষণা গৃহীত হয়েছে। 

দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য সমঝোতার মধ্য দিয়ে এই ঘোষণায় আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতিসংঘ সনদের আন্তর্জাতিক আইনসমূহ, নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো আলোচিত হয়েছে। এসব বিষয়ে সদস্য দেশগুলো সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

 দিল্লি সম্মেলনে আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০-এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করা একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যৌথভাবে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি এবং ১ দশমিক চার বিলিয়নের জনসংখ্যা নিয়ে আফ্রিকা শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসই নয়, অনেকগুলো উদীয়মান অর্থনীতির রাষ্ট্রের মহাদেশও বটে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি এবার আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি এই ফোরামে নজির তৈরি করল। আশা করা যায় যে, আফ্রিকান ইউনিয়ন প্যান আফ্রিকান বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসবে এবং জি-২০-এর আলাপচারিতায় বৈচিত্র্য আনবে।

ভারত বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সৌর জোটের মতো নানা উদ্যোগে আফ্রিকান দেশগুলোকে যুক্ত করার অনবরত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। অতি সম্প্রতি ভারত ব্রিকসে মিশর ও ইথিওপিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর উদ্যোগ নিয়েছে। এবার তাই দেশটিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আফ্রিকান রাষ্ট্রের উপস্থিতিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে।

 ন্যায্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী প্রতিরোধের ইতিহাস তৈরিতে ভারত-আফ্রিকা অংশীদারত্ব একটি যৌথ সমঝোতার উৎস সৃষ্টি করার সুযোগ নিয়ে এসেছে। যে মহাদেশের ঔপনিবেশিকতার নির্মমতা এবং নয়া ঔপনিবেশিক নীতির তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার রাষ্ট্রসমূহের মর্যাদাপূর্ণ অর্থনৈতিক মঞ্চের সদস্যপদ পাওয়াকে নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানো যায়। জি-২০-এর সদস্যপদ পাওয়া হয়তো বা এককভাবে আফ্রিকার ভাগ্য বদল করবে না, তবে মহাদেশটির অগ্রগতিকে স্বীকৃতি প্রদানে সহায়ক হবে। জি-২০-এ আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নশীল দেশগুলোর বর্ধনশীল রূপান্তরকেও নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে যে বহুমুখিনতা তৈরি হচ্ছে, তাতে আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে অনেক উন্নয়নশীল দেশ নিজেদেরকে সংযুক্তির পুনর্কল্পনা করতে পারছে। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ অর্থনৈতিক এবং সংযোগ কাঠামোতে যুক্ত করার মধ্যে উন্নত পশ্চিমেরও স্বার্থ রয়েছে। জি-২০ সম্মেলনের এক পর্যায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনের ট্রান্স-আফ্রিকান করিডরের ঘোষণা সেই বিষয়টিরই ইঙ্গিত বহন করে। এই প্রস্তাবিত করিডরে স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের সঙ্গে সাগরের সংযোগকে উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে অ্যাঙ্গোলার লবিটো বন্দরের সঙ্গে কঙ্গোর কাটিংগা প্রদেশ এবং জাম্বিয়ার তামার খনি সংবলিত অঞ্চলের সংযোগ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

 জি-২০ সম্মেলনে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর বা আইমেকের ঘোষণাকে একটি দারুণ উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনায় আনা উচিত। আইমেক সমঝোতা স্মারকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব আমিরাত এবং যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে। আইমেকে অবকাঠামো এবং সংযোগ প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এখানে বন্দর, জাহাজ থেকে রেলে স্থানান্তর সংযোগ, ইলেকট্রিসিটি নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল কেবলস এবং পরিষ্কার হাইড্রোজেন পরিবহনের মতো অনেকগুলো অবকাঠামো এবং সংযোগ প্রকল্প বিবেচনায় আনা হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে আরব দেশগুলো সারা বিশ্বের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি সংযোগের বিষয়টিকে স্থগিত করে রেখেছিল। আইমেকের চুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর বহুমুখী আন্তর্জাতিক যুক্ততাকে একত্রীকরণের নির্দেশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইমেক আবার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরব দেশগুলোর যুক্ততার গুরুত্বকে বিশেষভাবে আমলে নিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধিতে আরব দেশগুলোর জ্বালানি, ডিজিটাল এবং অবকাঠামো সহযোগিতা বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে।

আইমেকের মাধ্যমে ভারত এবং আরব দেশগুলোর সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র অগ্রগতি আসতে পারে। এমনিতেই আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিনিয়োগ, শিল্প এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলোতে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটছে। সম্প্রতি ভারতের ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই) এবং আরব আমিরাতের ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের (আইপিপি) সংযুক্তি তৈরি করা হয়েছে, যাতে এই দুই দেশের আন্তঃবৈদেশিক আর্থিক লেনদেন সহজ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী হতে পারে। এখন দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের অসমাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে ভারত এবং আরব বিশে^র কৌশলগত লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র অভিন্নতা গড়ে উঠতে পারে।

জি-২০তে বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানি যৌথতা বা জিবিএর ঘোষণা এই সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। জিবিএর মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির সহজলভ্যতা, সাপ্লাই লাইনকে নিরাপদ করা, উৎপাদনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং স্থায়ী কারিগরি সহায়তার মতো বিষয়গুলোর বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 জলবায়ু নীতি

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে জি-২০ উন্নত বিশ্বের প্রতি ‘২০২৫ সাল পর্যন্ত বছরে বছরে একশ বিলিয়নের যৌথ জলবায়ু তহবিল গঠনের লক্ষ্যমাত্রা’-কে জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের স্থায়িত্বে যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছিল। এবার জি-২০-তে স্থায়ী এবং প্রাণবন্ত ব্লু-ওশান নির্ভর অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চেন্নাই ঘোষণার মৌলিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। একইভাবে শুষ্ক অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি বিষয়ক কয়েকটি উঁচু পর্যায়ের নীতিও গ্রহণ করা গেছে।

এবার জি-২০ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমত জি-২০’র মতো উঁচু মানের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামকে ভূরাজনৈতিক ইস্যু বাস্তবায়নে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া ভূরাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত জি-২০-এর মাধ্যমে ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘কার্যকর বহুজনীন উন্নয়ন ব্যাংক’ গঠনে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে। তৃতীয়ত উন্নয়নশীল দক্ষিণের বিষয়ে পশ্চিমাদের একটি সহায়ক অবস্থান পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা উদীয়মান দেশগুলোর প্রতিনিধিদের বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের নীতি পর্যায়ে অবস্থান গ্রহণের বিষয়ে যে সদিচ্ছা দেখিয়েছে, তা অব্যাহত রাখা জরুরি। শেষত জি-২০-এর মাধ্যমে বৃহৎ শক্তির বৈশ্বিক বৈরিতায় যে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছিল, তার অনেকটা লাঘবের চেষ্টা করা হয়েছে। আঞ্চলিক স্বার্থগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং অ-প্রথাজনিত কৌশলগত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

 দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্বকে একটা যৌথতার অবস্থানে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভক্ত ও জটিল বৈশ্বিক সমস্যা কাটানোর একটি দীর্ঘমেয়াদি সেতুবন্ধ তৈরি হতে পারে।


লেখক : পলিয়াটিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাভাট ফেলো 

এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : অনিন্দ্য আরিফ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //