কোন ‘জনস্বার্থে’ এডিসি হারুন বরখাস্ত

‘তিনি শুধু পেটান।’ গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয় ডেইলি স্টার অনলাইনে। এর ঠিক এক বছর পর গত ১১ সেপ্টেম্বরের খবর : সাময়িক বরখাস্ত সেই এডিসি হারুন।

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে দুজন হারুন বেশ আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত। নানা সময়ে তারা দুজনই সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। এর মধ্যে একজন হারুনুর রশিদ আলোচিত হয়েছিলেন সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুককে পিটিয়ে। বর্তমানে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হয়েছেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে তার অফিসে নিয়ে ভাত খাওয়ানোর ঘটনায়। একইভাবে আরও একাধিক বিশিষ্ট লোককে তার অফিসে ভাত খাইয়েছেন এবং সেই ছবি গণমাধ্যম ও ফেসবুকেও ছড়িয়ে গেছে।

আরেকজন হারুন বারবার আলোচনায় এসেছেন, সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে বেদম লাঠিপেটা করে। অবশেষে ‘ধরা খেয়েছেন’ ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতাকে পিটিয়ে। যদিও এটি সাময়িক বরখাস্ত। তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে তিনি পুরোপুরি বরখাস্ত হবেন কি না বা বরখাস্ত হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ পর্যন্ত তিনি যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে বরখাস্তটিই যথেষ্ট কি না, সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

১১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন-অর-রশীদকে জনস্বার্থে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। প্রশ্ন হলো, এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও ক্ষমতার অপব্যবহার, মারধরসহ নানারকম অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। তখন এই ‘জনস্বার্থ’ কোথায় ছিল? এর আগে তিনি যাদেরকে মেরেছেন, সেগুলো কি জনস্বার্থে ছিল? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক সবশেষ কোন ঘটনায় তিনি ফাঁসলেন। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘটনার জেরে এডিসি হারুন রমনা থানায় নিয়ে বেদম মারধর করেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিমকে।

এই ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলে ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। ডিএমপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাদ্দাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’ এই ঘটনায় তারা মামলা করতে চান না বলেও জানান। এর কিছু সময় পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। থানায় নিয়ে বেদম মারধর এবং মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার ঘটনায় কেন মামলা হবে না, সেটি রাজনীতিসচেতন এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ যে কোনো মানুষ জানেন, বোঝেন। এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। 

শুধু ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের কারণেই যে হারুনকে বরখাস্ত করা হয়েছে, বিষয়টা হয়তো এত সরল নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে নারীঘটিত ইস্যু এবং যে ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক, যিনি সবশেষ নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন। অর্থাৎ তিনি প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এখানে এডিসি হারুনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পেছনে শুধু ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধর নয়, বরং প্রশাসন ক্যাডারেরও একটা ভূমিকা রয়েছে।

যদিও পুলিশের এই উপকমিশনার এর আগেও বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন মানুষ পেটানোর কারণে। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন-ভাতা নেওয়া একজন জনকর্মচারী কী করে এত উদ্ধত হতে পারেন, সেটি বিরাট প্রশ্ন। 

বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার মধ্যে রয়েছে গত বছরের ৭ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের ওপর নির্মম লাঠিপেটা। তিনি তখন রমনা জোনের এডিসি। এর আগে একজন সহকর্মীকে চড় মেরেও সমালোচিত হন এডিসি হারুন। নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান মালিক, বিক্রেতা ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের দিকে রাবারের বুলেট ছুড়তে এক কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন তিনি। বুলেট শেষ বলায় তাকে চড় মারেন। ঘটনাটির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন তিনি। 

গত বছরের ৪ মার্চ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণঅধিকার পরিষদের একটি মিছিলেও অতর্কিত লাঠিচার্জ করে বিতর্কিত হন হারুন-অর-রশীদ। তিনি কয়েকজন বিক্ষোভকারীর গলা টিপে ধরেছেন, এরকম ছবিও তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। 

২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠন আয়োজিত মশাল মিছিলেও এডিসি হারুনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ লাঠিপেটা করে। বিভিন্ন সময়ে ছবি তুলতে গিয়ে বা ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও এডিসি হারুনের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

তার এই ধরনের ‘উগ্র আচরণ’ পুলিশ বাহিনীকে ব্রিবত করছে এবং রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দিচ্ছে বলে নাগরিকদের তরফে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

কিন্তু এবার ছাত্রলীগকে মারধরের পর আর রেহাই পেলেন না। শুধু তাই নয়, একসময় এডিসি হারুনকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বলে যারা শ্লাঘা বোধ করেছেন, তারাও এখন তাকে ছাত্রদলের সাবেক নেতা এবং তার পরিবার জামায়াতসংশ্লিষ্ট বলে দাবি করছেন। অর্থাৎ যতক্ষণ সরকারবিরোধী লোকজনকে তিনি পিটিয়েছেন, ততক্ষণ তিনি ছাত্রলীগ। আর যখনই ছাত্রলীগের দুই নেতাকে পেটালেন, তখনই ছাত্রদল। ফলে যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, সবশেষ মার খাওয়া ব্যক্তিরা যদি ছাত্রলীগের নেতা না হয়ে অন্য কোনো দলের নেতাকর্মী বা সাধারণ নাগরিক হতেন, তাহলে কি এডিসি হারুন বরখাস্ত হতেন বা তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হতো? 

প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেদম মারধর, এমনকি মেরে দাঁত ফেলার সাহস পুলিশ কোথায় পেল? এই ক্ষমতা নিশ্চয়ই তাদেরকে দেওয়া হয়েছে কিংবা নানা ঘটনায় তারা এই ক্ষমতা অর্জন করেছে? অতএব মারধরের বিচার চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করে এরকম ‘মনস্টার’ হলো, সেই প্রশ্নটাও করা দরকার। 

পুলিশকে যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহার করা হয় তখন পুলিশ এটা মনে করতেই পারে যে, তারা সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে, অতএব যা খুশি করার অধিকার তাদের আছে। অথচ পুলিশের কাজ হচ্ছে সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। কারণ সেই জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন হয়। একজন নাগরিক, তার রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাকে পেটানোর অধিকার পুলিশের নেই। 

প্রশ্ন হলো সাময়িক বরখাস্ত এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে আনীত সবশেষ অভিযোগটি যদি তদন্তে সত্য প্রমাণ হয়, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি কী হবে? তার বিরুদ্ধে কি শুধু এই একটি ঘটনারই তদন্ত হবে নাকি আরও যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোও আমলে নেওয়া হবে? যে নারীঘটিত ইস্যুতে ঘটনার সূত্রপাত, সেটিরও কি তদন্ত হবে? কারা এই অভিযোগের তদন্ত করবেন? পুলিশ তার নিজের বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কি নির্মোহভাবে তদন্ত করতে পারবে বা করবে? 

সরকারি কর্মচারীদের একটি বিরাট রক্ষাকবচের নাম ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’। প্রতিটি আইনের শেষে এরকম একটি বিধান থাকে যে, সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহও কি এই কথিত সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত দায়মুক্তি দেওয়া হবে, নাকি এই ঘটনার সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার স্বার্থ যুক্ত আছে বলে এই দফায় তিনি আর পার পাবেন না, সেটি দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

মোদ্দা কথা, পুলিশের সবাই এডিসি হারুন নন। অসংখ্য সৎ ও জনবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য আছেন, যারা সত্যিই মানুষকে সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু সেই মানুষদের ভালো কাজগুলোও ম্লান হয়ে যায় এইসব লোকের কারণে। 

কোনো একটি অপরাধ ঘটলেই বলা হয়, ব্যক্তির অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না। এটি নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পুরস্কারসহ যাবতীয় বিষয় যদি ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই সিস্টেমের ভেতরে কেউ যখন অপরাধ করে, তার দায় প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে না। অতএব খারাপ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে যদি দলীয় বিবেচনাটিই মুখ্য হয়, তাহলে সেই বাহিনীকে দিয়ে জনসেবা সম্ভব নয়। বরং তারা নানারকম অপরাধ করতে থাকবে এবং কালেভদ্রে দুয়েকটি ঘটনায় তাদের কেউ কেউ আলোচনায় আসবেন; সমালোচিত হবেন এবং হতভাগা কারও হয়তো ‘পচা শামুকে পা কাটবে’; তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //