নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদের নাক গলানো প্রসঙ্গ

‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’- এটাকে অমোঘ সত্য ধরেই ষাটের দশকের গণজাগরণ স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। সহজেই বলা যায়, ওই প্রত্যয়ই আমাদের জাতিকে পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বেলিত করেছিল।

আন্দোলনে থাকা অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণে করলে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঊনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারি দিনটির কথা। মতিউর-রুস্তম-মকবুল-হারিশ-শহীদ নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে ফয়সলা করতে ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তায় জনগণ নেমে এসেছিল।

‘লোক লোক চোখের পাতায় লোক/হৃদয়ের প্রতিটি স্কোয়ারে লোক’- কবি শামসুর রাহমান এভাবেই ওই দিনের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। সরকার সামরিক বাহিনী তলব করে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে এখনো মনে পড়ে, রাতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময় কারফিউ না ভাঙার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। পার্টি বলেছিল, ‘সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র জনগণের প্রত্যক্ষ লড়াই করার কোনো অর্থ হয় না।’ 

কিন্তু বস্তিবাসী জনগণ তা মানেনি। প্রচণ্ড ক্ষোভে ঈপ্সিত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিলিটারি-ইপিআর-পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে সংগ্রামের পথকে অবারিত করেছিল। ওই দিনগুলোর রক্তাক্ত স্মৃতি ধারণ করে আছেন, এমন কোনো ব্যক্তিই বোধকরি ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ প্রত্যয়টি থেকে সরে আসতে পারবেন না। ইতোমধ্যে বিগত  প্রায় ৫৫ বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে বহু পানি গড়িয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তেমনি গঙ্গা-ইয়াংসিকিয়ান-ভলগা-দানিয়ুব-মিসিসিপি-নীল নদ দিয়েও পানি গড়িয়ে গেছে সাত সমুদ্রে। আমেরিকা- সোভিয়েত ইউনিয়ন- এই দুই পরাশক্তির নেতৃত্বে দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এখন বিশ্ব বহু কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে গেছে। 

বর্তমান কালপর্বে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, ন্যায়ভিত্তিক মানবিকতা নির্বাসিত হতে যাচ্ছে। ক্রমেই জাতীয় ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ছোট ছোট রাষ্ট্রকে দাবিয়ে রাখার জন্য নানারূপী আগ্রাসন, লোভ-লালসার পরাক্রম, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি বিশ্ব রাজনীতিকে গ্রাস করে চলেছে। অর্থনৈতিক নানামুখী সংকটের মধ্যে শক্তিধর দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা এখন রাখডাক বা লাজলজ্জার বলাই রাখছে না। আমেরিকা চাইছে বিশ্ব আধিপত্য ধরে রাখতে আর অন্যান্য শক্তি কেন্দ্রগুলো চাইছে যার যার দেশের প্রভাব বলয় বাড়াতে।

চীন ও রাশিয়া হালে আমেরিকার কর্তৃত্বকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এরই পরিণতি। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের ঘোষণায় ভারত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, জর্ডান, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটেভের বিপরীত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রতিযোগিতা নতুন রূপে বিশ্বকে যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ঘটতে থাকা এসব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত জাতীয় চার নীতির এক নীতি সমাজতন্ত্রও হয়ে গেছে যেন দূরের বাদ্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, জাতীয় চার নীতি আমাদের চারটি খুঁটি। যার ওপর দেশ দাঁড়াবে। একটার বিপদ মানে সবটার বিপদ। এ কারণেই বোধকরি সাম্যের চেতনা যেমন, তেমনি জাতীয়তাবাদ-ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রও আজ বিপদাপন্ন।

এই অবস্থায় জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিক থেকে যে, নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অর্জন ও সাফল্য যেমন সমাজের সব ক্ষেত্রকে, সব মানুষের জীবন ও জীবিকাকে উন্নত করে, তেমনি রাষ্ট্র ক্ষমতার বিফলতা-ব্যর্থতা সর্বৈবভাবে সবাইকে আঘাত করে। বিগত ১০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘সারা দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে।’ কোনো সরকারের আমলে যখন তা বাড়ে তখন দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই আঘাত করে। 

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব নির্বাচন সামনে রেখেই সরকার ও বিরোধী দলে টানাপড়েন যেমন হয়েছে, তেমনি বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাও লক্ষ্য করা গেছে। 

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে পা দিয়েই অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় শাসনতন্ত্র রচনার কাজ এবং শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। তাই কোনো দিক থেকেই বলা যাবে না, স্বাধীনতা উষালগ্নে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচনে বিদেশের কোনো নাক গলানোর কাণ্ডকারখানা ছিল। বাম-কমিউনিস্টরা এসব প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেও প্রথম দিকে দেশ সংসদীয় প্রক্রিয়ায় যাক, তা চাইছিল না। ন্যাপ (মোজাফফর) মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উপদেষ্টা পরিষদের আদলে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল। 

সেটা ভালো হতো না মন্দ হতো সেই বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, আমাদের জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনো বিদেশি শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব জাতীয় ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার অনুযায়ী। খুনি মোশতাকের শাসনামল সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। ওই আমলে নির্বাচন কোনো ইস্যু ছিল না। নিতান্ত অন্ধ না হলেই দেখা যাবে, পশ্চিমা দাতা দেশ ও সংস্থার চাপে, বিশেষত ‘মুক্ত দুনিয়ার’ প্রবক্তা আমেরিকার চাপেই সেনাশাসক জিয়া সামরিক শাসনের মধ্যে ‘হুকুমের’ হাঁ-না ভোট, সংসদ নির্বাচন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ভোট কীভাবে হলো, কতটা ভোট পড়ল, তাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কতটুকু কী হলো, তা নিয়ে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ কোনো মাথাব্যথা ছিল না। দরকার ছিল ভোটের সরকার।

সেনাশাসক এরশাদ আমলে ‘মুক্ত দুনিয়ার’ সেই চাপ আরও বাড়ে এবং প্রহসনের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এককথায় ওই দুই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। নব্বইয়ের গণউত্থানের ভেতর দিয়ে আবারও গণমনে আশা জাগ্রত হয়। কিন্তু প্রথমে মাগুরা উপনির্বাচন আর পরে ৯৬-এর ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নব্বইয়ের গণউত্থানের চেতনা পদদলিত হয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ভোট সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।

২০০১ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। ওই নির্বাচনে শা-ল-সা সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় একটি পেরেক পুঁতে দেয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাতে ওই ব্যবস্থায় শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। ওই বছর নির্বাচন হতে পারেনি এবং জরুরি আইনের শাসন আসে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলেই। ওই শাসনামলে দুই নেত্রীকে মাইনাস এবং ড. ইউনূসকে দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করে দেশ চালানোর পেছনে যে বিদেশিদের বড্ড বেশি নাক গলানো ছিল, তা সুস্পষ্ট।

যে কোনো দেশের রাজনীতিতে একবার যদি শক্তিধরেরা নাক গলানোর সুযোগ পায় কিংবা সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তা কাঁঠালের আঠার মতো হয়ে যায়। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় এখন তা হয়েছে অক্টোপাস। ভাবতে অবাক লাগে, আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়া নাক গলাচ্ছে, এমন অভিযোগও আমাদের শুনতে হয়েছে। বড়রাই যদি বড়দের মধ্যে নাক গলায়, তবে আমাদের মতো ছোট দেশগুলো তো এখন নস্যি!

উপমহাদেশের দেশগুলোর দিকে তাকালে নস্যি হওয়ার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তনসহ রাজনৈতিক ঘটনাবলি পরিবর্তন হলে বলা হচ্ছে, ইমরানকে সরিয়েছে আমেরিকা আর সেনাবাহিনী আমেরিকার পক্ষে। শ্রীলংকা সংকটের সময় বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ ‘রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের আনুকূল্যে চীনের অধিপত্য বেড়েই চলছে।’ এখন শ্রীলংকা ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলছে। তবে সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের টানাপড়েন লক্ষণীয়।

অটল হিমালয়ের দেশ নেপালের রাজনীতি রয়েছে চরম টানাপড়েনের মধ্যে। দুই চীনপন্থি মাওবাদী দলের নেতা পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড ও খড়্গ প্রসাদ ওলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০২২ সালে সরকার গঠন করে। চীন প্রভাবিত এই দুই নেতা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে প্রচণ্ড আড়াই বছর এবং পরে ওলি আড়াই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। আড়াই বছর সামনে রেখে ঐক্য ভেঙে দিয়ে প্রচণ্ডই প্রধানমন্ত্রী থেকে যান এবং তার সমর্থনে নেপালি কংগ্রেস নেতা রামচন্দ্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রচারিত হচ্ছে, নেপাল এখন ভারতের দিকে ঝুঁকছে। 

এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি তথা আসন্ন ভোটে যে বিদেশিরা নাক গলিয়ে আছে, তা থেকে আমরা উদ্ধার পেয়ে জাতি জন্মের উৎসমুখে কি যেতে পারব? রাজনীতিতে একটা কথা রয়েছে যে, এখনই যদি বৃত্ত ভাঙা না যায়, তবে বৃত্তের মধ্যে থেকেই বৃত্ত ভেঙে বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু কাজের কথাটা কী? এটা বোধকরি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে দেশবাসী চাইবে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক এবং নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হোক। জনগণই হোক সকল ক্ষমতার উৎস।  


শেখর দত্ত: কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //